সঙ্কুচিত শহর: যেখানে দালানগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু মানুষ থাকে না

0



জার্নাল এন্ট্রি: ১ 

তারিখ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ লোকেশন: ডেট্রয়েট, মিশিগান, ইউএসএ

আমি দাঁড়িয়ে আছি মিশিগান সেন্ট্রাল স্টেশনের বিশাল, পরিত্যক্ত হলরুমে। একসময় এই স্টেশনটি ছিল আমেরিকার শিল্পশক্তির প্রতীক, হাজার হাজার মানুষের কোলাহলে মুখরিত এক জংশন। আজ, এর ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে, দেয়ালে গ্রাফিতির আঁচড়, আর মেঝেতে ধুলার আস্তর। এই স্টেশনটি একা নয়। পুরো ডেট্রয়েট শহরটাই যেন এক বিশাল ভূতুড়ে বাড়ি। এমন শত শত স্কুল, থিয়েটার, এবং হাজার হাজার বাড়িঘর এখানে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন সময়ের স্রোতে জমে যাওয়া এক একটি ফসিল।

এগুলোকে বলা হয় 'সঙ্কুচিত শহর' বা 'Shrinking Cities'—যে শহরগুলো তাদের জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের একটি বড় অংশ হারিয়েছে। আমি একজন আরবান এক্সপ্লোরার। আমার কাজ হলো এই সব পরিত্যক্ত এবং ভুলে যাওয়া জায়গাগুলোর গল্প খোঁজা। এই শহরগুলোর ভূত কোনো অশরীরী আত্মা নয়, এদের ভূত হলো অর্থনৈতিক পরিবর্তন, জনসংখ্যার স্থানান্তর এবং হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন।

জার্নাল এন্ট্রি: ২ 

লোকেশন: ইয়ুবারি, হোক্কাইডো, জাপান

ডেট্রয়েটের 'রাস্ট বেল্ট' বা মরিচা পড়া শিল্পের ভূতকে পেছনে ফেলে আমি এসেছি জাপানের এক পাহাড়ি শহর, ইয়ুবারিতে। এখানকার ভূতটি ভিন্ন। এটি কোনো অর্থনৈতিক পতনের ভূত নয়, এটি 'জনসংখ্যার' ভূত।

ইয়ুবারি ছিল একসময় এক সমৃদ্ধ কয়লা খনির শহর। কিন্তু খনিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, তরুণ প্রজন্ম কাজের সন্ধানে টোকিও বা ওসাকার মতো বড় শহরগুলোতে চলে গেছে। যারা এখানে রয়ে গেছেন, তাদের বেশিরভাগই প্রবীণ। শহরটির জনসংখ্যা গত পঞ্চাশ বছরে ৯০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে।

আজ আমি ইয়ুবারির পরিত্যক্ত স্কুলটির করিডোর দিয়ে হাঁটছি। ক্লাসরুমের ভেতরে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিলগুলো এখনও সাজানো, কিন্তু তাতে বসার মতো কোনো শিশু নেই। দেয়ালের রঙচটা ছবিগুলো যেন এক সুখী অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের প্রধান রাস্তাটি প্রায় জনশূন্য। কয়েকটি দোকান খোলা আছে, কিন্তু ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যাই বেশি। এখানকার নীরবতা ডেট্রয়েটের চেয়েও বেশি গা ছমছমে। কারণ এটি একটি শহরের ধীরে ধীরে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। জাপানের এই 'সিলভার সুনামি' বা প্রবীণদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিম্ন জন্মহারের সমস্যাটি অনেক উন্নত বিশ্বের জন্যই এক অশনি সংকেত।

জার্নাল এন্ট্রি: ৩ 

লোকেশন: একটি নামহীন শহর, পূর্ব জার্মানি

আমার পরবর্তী গন্তব্য ছিল পূর্ব জার্মানির কোনো এক শহর, যা একসময় জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (GDR)-এর অংশ ছিল। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর, দুই জার্মানি একীভূত হয়। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কিন্তু এর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছিল।

পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অধীনে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো পশ্চিমা পুঁজিবাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একে একে বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ এবং শিক্ষিত প্রজন্ম, আরও ভালো জীবন এবং চাকরির আশায় পশ্চিম জার্মানিতে পাড়ি জমায়।

আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে, যাকে বলা হয় 'প্ল্যাটেনবাউ'। সোভিয়েত ধাঁচের এই ধূসর, কংক্রিটের বিল্ডিংগুলো একসময় হাজার হাজার পরিবারের আবাসস্থল ছিল। আজ, এর বেশিরভাগ অ্যাপার্টমেন্টই খালি, জানালাগুলো ভাঙা। এই শহরটির ভূত হলো 'রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের' ভূত। এটি দেখায় যে, কীভাবে বড় ধরনের ঐতিহাসিক পরিবর্তন একটি অঞ্চলের ভূগোল এবং জনসংখ্যাকে চিরতরে বদলে দিতে পারে।

তদন্ত: এই ভূতুড়ে উপস্থিতির কারণ কী?

আমার এই যাত্রায়, আমি সঙ্কুচিত শহরগুলোর পেছনে কিছু সাধারণ কারণ খুঁজে পেয়েছি:

  • শিল্পায়ন-উত্তর পতন (Deindustrialization): ডেট্রয়েটের মতো অনেক শহর একটি মাত্র শিল্পের (যেমন: গাড়ি, স্টিল) উপর নির্ভরশীল ছিল। যখন সেই শিল্পটি ধসে পড়ে বা অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হয়, তখন পুরো শহরের অর্থনৈতিক ভিত্তিই ভেঙে পড়ে।

  • জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন (Demographic Change): জাপানের মতো অনেক উন্নত দেশে নিম্ন জন্মহার এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। এর ফলে, ছোট শহর এবং গ্রামগুলো ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ছে।

  • রাজনৈতিক রূপান্তর (Political Transition): পূর্ব জার্মানির উদাহরণ দেখায় যে, বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন কীভাবে ব্যাপকহারে জনসংখ্যার স্থানান্তর ঘটাতে পারে।

  • পরিবেশগত বিপর্যয়: চেরনোবিলের মতো পারমাণবিক দুর্ঘটনা বা আরল সাগরের মতো পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেও পুরো একটি শহর বা অঞ্চল পরিত্যক্ত হয়ে যেতে পারে।

ভূতের সাথে বসবাস

এই সঙ্কুচিত শহরগুলোর গল্প কেবলই হতাশার গল্প নয়। এটি মানুষের সহনশীলতা এবং নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোরও গল্প। অনেক শহরই এখন তাদের এই 'সঙ্কোচন'-কে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে। ডেট্রয়েটে, তরুণ শিল্পীরা পরিত্যক্ত কারখানাগুলোকে আর্ট গ্যালারি এবং স্টুডিওতে রূপান্তরিত করছে। খালি প্লটগুলোতে গড়ে উঠছে আরবান ফার্ম বা শহুরে কৃষি খামার। জার্মানির লাইপজিগ, যা একসময় দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছিল, তা এখন তার সাশ্রয়ী জীবনযাত্রা এবং সৃজনশীল পরিবেশের কারণে আবার নতুন করে তরুণদের আকৃষ্ট করছে। তারা তাদের পুরনো বিল্ডিংগুলোকে ধ্বংস না করে, সেগুলোকে নতুন করে ডিজাইন করছে।

এই শহরগুলো আমাদের শেখায় যে, বৃদ্ধিই উন্নয়নের একমাত্র পরিমাপক নয়। একটি শহরকে সবসময় আরও বড় এবং আরও জনবহুল হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বরং, একটি ছোট, আরও টেকসই এবং আরও সবুজ শহর হিসেবেও নতুন করে জীবন শুরু করা সম্ভব। এই 'ভূতুড়ে' দালানগুলো হয়তো অতীতের ব্যর্থতার সাক্ষী, কিন্তু একই সাথে এগুলো ভবিষ্যতের নতুন সম্ভাবনারও ক্যানভাস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!