শ্রীলঙ্কার ‘উপহার’, টাইগারদের ‘অগ্নিপরীক্ষা’: সুপার ফোরের সমীকরণে বাংলাদেশ কি পারবে স্বপ্ন পূরণ করতে?

0


অন্যের জয়ে বেঁচে থাকা এক স্বপ্নের নাম

ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের সমর্থকদের চেয়ে বড় গণিতবিদ হয়তো আর কেউ নেই। প্রতিটি টুর্নামেন্টে আমরা খাতা-কলম হাতে এমন সব জটিল সমীকরণের সমাধান করি, যা হয়তো গণিত অলিম্পিয়াডের সমস্যাকেও হার মানাবে। এবারের এশিয়া কাপও তার ব্যতিক্রম ছিল না। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে যখন আফগানিস্তানের বিশ্বসেরা বোলিং আক্রমণের সামনে শ্রীলঙ্কা ব্যাট করতে নামলো, তখন বাংলাদেশের কোটি সমর্থক এক অদ্ভূত দোলাচলে। একদিকে মন বলছে, আফগান স্পিনের সামনে এই রান তাড়া করা প্রায় অসম্ভব; অন্যদিকে হৃদয় চাইছে, যেকোনো মূল্যে শ্রীলঙ্কা জিতুক।

শুরুতে তো ভাবাই যায়নি যে আফগানদের দেওয়া টার্গেট শ্রীলঙ্কা চেজ করতে পারবে। রশিদ খান, মুজিব উর রহমান, আর মোহাম্মদ নবি—এই স্পিন ত্রয়ীর বিপক্ষে রান তোলা মানে আগুন নিয়ে খেলা। কিন্তু সব হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়ে শ্রীলঙ্কা এক অবিশ্বাস্য জয় তুলে নিল। তারা শুধু জেতেনি, বরং বুঝিয়ে দিয়েছে যে এবারের এশিয়া কাপের শিরোপা তারাও ডিজার্ভ করে। আর তাদের এই জয়ের মধ্য দিয়েই, অনেকটা ভাগ্য এবং শ্রীলঙ্কার দৌলতে, বাংলাদেশ জায়গা করে নিল সুপার ফোরে।

এখন প্রশ্ন হলো, ভাগ্যক্রমে পাওয়া এই ‘লাইফলাইন’ বা সুযোগের সদ্ব্যবহার কি টিম বাংলাদেশ করতে পারবে? যে দলটিকে সুপার ফোরে যেতে অন্যের জয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে, সেই দলটিই কি अब নিজেদের ভাগ্য নিজেরা লিখতে পারবে? সামনে শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং আফগানিস্তানের মতো কঠিন প্রতিপক্ষ। এই অগ্নিপরীক্ষায় টাইগাররা কতটা প্রস্তুত, চলুন সেই আলোচনাতেই ডুব দেওয়া যাক।

যে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচটি ভাগ্য গড়ে দিল: সুপার ফোরে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করার আগে, আফগানিস্তান বনাম শ্রীলঙ্কার সেই ম্যাচটির কথা না বললেই নয়। ম্যাচটি কেবল শ্রীলঙ্কাকে জেতায়নি, বরং বাংলাদেশের জন্য খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার দুয়ার। আফগানিস্তানের বোলিং লাইনআপ, বিশেষ করে তাদের স্পিন আক্রমণ, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের অন্যতম সেরা। এমন বোলিংয়ের বিপক্ষে রান তাড়া করতে প্রয়োজন ছিল সাহস, কৌশল এবং ঠাণ্ডা মাথার। শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছেন।

তারা রশিদ খানকে সমীহ করেছেন, কিন্তু তার বলকে ভয় পাননি। মুজিব বা নবির বাজে বলকে সীমানা ছাড়া করতেও দ্বিধা করেননি। কুশল মেন্ডিস, চারিথ আসালাঙ্কা এবং ভানুকা রাজাপাকসের মতো ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন। এই জয় শ্রীলঙ্কার আত্মবিশ্বাসকে নিঃসন্দেহে তুঙ্গে নিয়ে যাবে, যা সুপার ফোরে তাদের আরও ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। আর এই ম্যাচের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, কোনো বোলিং আক্রমণই দুর্ভেদ্য নয়। সঠিক পরিকল্পনা এবং নির্ভীক ক্রিকেট খেলতে পারলে যেকোনো প্রতিপক্ষকেই হারানো সম্ভব। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য এই ম্যাচটি একটি বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে।

সুপার ফোরের অগ্নিপরীক্ষা—বাংলাদেশের সামনে তিন চ্যালেঞ্জ: ভাগ্যক্রমে সুপার ফোরে জায়গা পেলেও, এখান থেকে ফাইনালের পথচলা মোটেও সহজ হবে না। বাংলাদেশকে লড়তে হবে তিনটি শক্তিশালী দলের বিপক্ষে। প্রতিটি ম্যাচই হবে ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ।

১. প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা (২০শে সেপ্টেম্বর): ঋণের প্রতিদান নাকি শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই?

সুপার ফোরে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষই হলো শ্রীলঙ্কা, যাদের জয়ে আমরা এই পর্যায়ে এসেছি। একদিকে যেমন তাদের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করছে, অন্যদিকে মাঠের খেলায় কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তেজনা। সেই ‘নাগিন ড্যান্স’ থেকে শুরু করে কথার লড়াই—সবকিছুই এই ম্যাচকে এক ভিন্ন মাত্রা দেয়।

  • শ্রীলঙ্কার শক্তি: তাদের মূল শক্তি হলো ভারসাম্যপূর্ণ একটি দল। ব্যাটিংয়ে পাথুম নিশাঙ্কা, কুশল মেন্ডিসরা যেমন ধারাবাহিক, তেমনি মিডল অর্ডারে আসালাঙ্কা এবং অধিনায়ক দাসুন শানাকা দ্রুত রান তুলতে সক্ষম। বোলিংয়ে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা এবং মহেশ থিকশানার স্পিন জুটি বিশ্বের যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপের জন্য হুমকি।

  • বাংলাদেশের করণীয়: শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিততে হলে বাংলাদেশের টপ অর্ডারকে জ্বলে উঠতেই হবে। লিটন দাস, তানজিদ তামিমদের কাছ থেকে একটি ভালো শুরু খুব জরুরি। মিডল অর্ডারে জাকের আলি এবং তৌহিদ হৃদয়ের উপর থাকবে ইনিংস গড়ার দায়িত্ব। বোলিংয়ে তাসকিন আহমেদের গতি এবং শরিফুল ইসলামের সুইং মুস্তাফিজ এর কাঁটার পাওয়ার প্লে-তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর হাসারাঙ্গা-থিকশানার স্পিন সামলানোর জন্য প্রয়োজন হবে ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার।

এই ম্যাচটি হবে মূলত স্নায়ুর লড়াই। যে দল চাপের মুহূর্তে নিজেদের ধরে রাখতে পারবে, তারাই জিতবে। সুপার ফোরে ভালো শুরু করার জন্য এই ম্যাচে জয় বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য।

২. প্রতিপক্ষ ভারত (২৪শে সেপ্টেম্বর): জায়ান্টদের বিপক্ষে বাঘের গর্জন?

কাগজে-কলমে এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দল ভারত। তাদের বিপক্ষে ম্যাচটি হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, বড় দলের বিপক্ষে ভালো খেলার ইতিহাস বাংলাদেশের রয়েছে। এই ম্যাচে হারানোর ভয় কম থাকায় টাইগাররা হয়তো নির্ভীক ক্রিকেট খেলতে পারবে।

  • ভারতের শক্তি: রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, সূর্যকুমার যাদব, হার্দিক পান্ডিয়াদের নিয়ে গড়া ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ বিশ্বের সেরা। বোলিংয়ে জাসপ্রিত বুমরাহ,  কুলদীপ যাদবের চায়নাম্যান বোলিং যেকোনো দলকে সমস্যায় ফেলতে পারে। তারা প্রতিটি বিভাগেই শক্তিশালী।

  • বাংলাদেশের করণীয়: ভারতের বিপক্ষে জিততে হলে বাংলাদেশকে তাদের সেরা খেলার চেয়েও ভালো কিছু করতে হবে। ব্যাটিংয়ে ২০০-র কাছাকাছি স্কোর গড়ার লক্ষ্য রাখতে হবে। লিটন দাস বা তানজিদ তামিমের মতো কাউকে একটি বিস্ফোরক ইনিংস খেলতে হবে। বোলিংয়ে শুরুতেই উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে চাপে ফেলতে হবে। বিশেষ করে, মুস্তাফিজুর রহমানের কাটার এবং নাসুম এর অভিজ্ঞ বোলিং এই ম্যাচে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

এই ম্যাচে জয় পাওয়া কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে একটি ভালো ওভার বা একটি দুর্দান্ত ইনিংসই ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ যদি দল হিসেবে খেলতে পারে, তবে অঘটন ঘটানো সম্ভব।

৩. প্রতিপক্ষ পাকিস্তান (২৫শে সেপ্টেম্বর): গতির ঝড়ের মুখে টাইগারদের পরীক্ষা

সুপার ফোরের তৃতীয় প্রতিপক্ষ পাকিস্তান—ক্রিকেটের এক পরাশক্তি এবং বাংলাদেশের অন্যতম চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণের চেয়েও ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে পাকিস্তানের বিশ্বসেরা পেস আক্রমণের বিপক্ষে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই বাড়তি চাপ এবং ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালের মতো বহু স্মরণীয় মুহূর্তের রোমন্থন।

  • পাকিস্তানের শক্তি: তাদের মূল শক্তি হলো শাহীন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ এবং হারিস রউফকে নিয়ে গড়া অপ্রতিরোধ্য পেস আক্রমণ। বিশ্বের যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপের জন্য এই পেস ত্রয়ী এক দুঃস্বপ্ন। ব্যাটিংয়ে বাবর আজম এবং মোহাম্মদ রিজওয়ানের জুটি বিশ্বের অন্যতম সেরা। মিডল অর্ডারে ইফতিখার আহমেদের মতো পাওয়ার হিটাররা দ্রুত ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।

  • বাংলাদেশের করণীয়: পাকিস্তানের বিপক্ষে জেতার প্রথম শর্তই হলো তাদের পেস আক্রমণ সামাল দেওয়া, বিশেষ করে শাহীন আফ্রিদির প্রথম স্পেল। লিটন দাস এবং অন্য টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শুরু করতে হবে। বাবর-রিজওয়ান জুটিকে দ্রুত ভাঙতে না পারলে বড় স্কোর তাড়া করা কঠিন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাসকিন আহমেদের গতি এবং সাকিব আল হাসানের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং বড় ভূমিকা রাখতে পারে। মানসিক দৃঢ়তা ধরে রেখে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়াই হবে এই ম্যাচের মূল চাবিকাঠি।

এই ম্যাচটি সম্ভবত একটি লো-স্কোরিং থ্রিলার হতে পারে, যেখানে প্রতিটি রানই গুরুত্বপূর্ণ।

সুযোগ যখন দরজায়, স্বপ্ন কি পূরণ হবে?

ভাগ্য হয়তো বাংলাদেশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন, কিন্তু ভাগ্য সবসময় সাহসীদেরই সঙ্গ দেয়। সুপার ফোরে ওঠাটা ছিল ভাগ্যের সহায়তা, কিন্তু এখান থেকে ফাইনালের পথ তৈরি করতে হবে নিজেদের যোগ্যতায়। দলের টপ অর্ডারের ধারাবাহিকতার অভাব, ডেথ ওভারের বোলিং এবং চাপের মুখে ভেঙে পড়ার পুরনো রোগগুলো সারাতে না পারলে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা কঠিন হবে।

অধিনায়ক লিটন দাসের কাঁধেই থাকবে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তার পারফরম্যান্সের পাশাপাশি তার নেতৃত্বও হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাসকিন আহমেদ এবং মুস্তাফিজুর রহমানের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। একই সাথে, তৌহিদ হৃদয় বা রিশাদ হোসেনের মতো তরুণদের কাছ থেকেও চাই সাহসী পারফরম্যান্স।

সমর্থক হিসেবে আমরা আমাদের ‘অংকের খাতা’ আপাতত বন্ধ রাখতে চাই। আমরা আর ‘যদি-কিন্তু’র সমীকরণে নিজেদের ভাগ্য খুঁজতে চাই না। আমরা চাই, বাংলাদেশ দল মাঠে খেলুক চ্যাম্পিয়নের মতো। তারা নির্ভীক ক্রিকেট খেলুক, জয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ুক। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, লড়াইটা যেন হয় বাঘের মতো। এই ‘দ্বিতীয় জীবন’টাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ কি পারবে এশিয়া কাপের ফাইনাালের স্বপ্ন পূরণ করতে? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!