এক দশক আগেও বিনোদনের জন্য আমাদের প্রধান অবলম্বন ছিল টেলিভিশন। নির্দিষ্ট সময়ে প্রিয় সিরিয়াল বা সিনেমা দেখার জন্য অপেক্ষা করা, আর বিজ্ঞাপন বিরতির বিরক্তি—এগুলোই ছিল আমাদের বিনোদন জগতের চেনা ছবি। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই দৃশ্যপট আমূল বদলে গেছে। ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের হাত ধরে এসেছে এক নতুন বিপ্লব, যার নাম 'স্ট্রিমিং'।
অন-ডিমান্ড বিনোদন: যখন ইচ্ছা, যা ইচ্ছা দেখার স্বাধীনতা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো 'অন-ডিমান্ড' মডেল। এখানে আপনাকে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। আপনি আপনার সুবিধামতো সময়ে, যেকোনো জায়গা থেকে, যেকোনো ডিভাইসে আপনার পছন্দের সিনেমা, ওয়েব সিরিজ বা ডকুমেন্টারি দেখতে পারেন।
বিঞ্জ-ওয়াচিং (Binge-Watching): স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায়শই একটি সিরিজের সবগুলো পর্ব একসাথে মুক্তি দেয়। এর ফলে দর্শকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একটানা সিরিজ দেখে শেষ করার সুযোগ পান, যা 'বিঞ্জ-ওয়াচিং' নামে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে।
বিজ্ঞাপনমুক্ত অভিজ্ঞতা: সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক মডেল হওয়ায় 대부분 প্ল্যাটফর্মই বিজ্ঞাপনমুক্ত বিনোদনের সুযোগ দেয়, যা দর্শকদের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক অভিজ্ঞতা।
কনটেন্টের বৈচিত্র্য এবং নতুন গল্পের উত্থান: টেলিভিশন বা সিনেমার জগতে প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট ঘরানার গল্পের প্রাধান্য দেখা যেত, যা বক্স অফিসে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরণের দর্শকের কথা মাথায় রেখে কনটেন্ট তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক কনটেন্টের সহজলভ্যতা: নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর কারণে আমরা এখন সহজেই কোরিয়ান ড্রামা 'স্কুইড গেম', স্প্যানিশ সিরিজ 'মানি হাইস্ট' বা তুর্কি সিনেমার সাথে পরিচিত হতে পারছি। ভাষার বাধা অতিক্রম করে ভালো গল্প এখন সারা বিশ্বের দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
দেশীয় প্ল্যাটফর্মের উত্থান: 'হইচই', 'চরকি', 'বঙ্গো'র মতো দেশীয় প্ল্যাটফর্মগুলো বিশেষভাবে বাংলাভাষী দর্শকদের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছে। এর ফলে বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান নির্মাতা, অভিনেতা এবং কলাকুশলীরা তাদের সৃজনশীল কাজ প্রদর্শনের একটি বড় সুযোগ পাচ্ছেন। 'তাকদীর', 'কারাগার' বা 'মহানগর'-এর মতো ওয়েব সিরিজগুলো প্রমাণ করেছে যে, ভালো গল্প এবং নির্মাণ হলে দেশীয় কনটেন্টও আন্তর্জাতিক মানের হতে পারে।
সিনেমা হল এবং টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ: স্ট্রিমিংয়ের এই উত্থান প্রচলিত মাধ্যমগুলোর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সিনেমা হলের সংকট: অনেক দর্শক এখন নতুন সিনেমা মুক্তির জন্য অপেক্ষা না করে কয়েক মাস পর স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে দেখার জন্য আগ্রহী। এর ফলে সিনেমা হলগুলো দর্শক হারাচ্ছে। অনেক বড় বড় প্রযোজনা সংস্থাও এখন সরাসরি তাদের সিনেমা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দিচ্ছে।
টেলিভিশনের পরিবর্তন: দর্শকরা যেহেতু এখন তাদের পছন্দমতো সময়ে অনুষ্ঠান দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, তাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও তাদের অনুষ্ঠানসূচি এবং কনটেন্টের ধরণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
স্ট্রিমিংয়ের নেতিবাচক দিক: এই বিপ্লবের কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। একাধিক প্ল্যাটফর্মে সাবস্ক্রিপশন ধরে রাখাটা বেশ ব্যয়বহুল। এছাড়া, বিঞ্জ-ওয়াচিংয়ের প্রবণতা অনেক সময় আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়, যা মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
উপসংহার: ভালো বা মন্দ, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের বিনোদনের জগতে এক необрати পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এটি দর্শকদের দিয়েছে অভূতপূর্ব স্বাধীনতা এবং নির্মাতাদের দিয়েছে নতুন নতুন গল্প বলার সাহস। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এই মাধ্যমের আরও বিবর্তন ঘটবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, অন-ডিমান্ড বিনোদনের এই যুগ আমাদের সাথে থাকবে।
