ভূমিকা
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি ডিজিটাল দেশে রূপ নিচ্ছে। সরকারি দপ্তরের কাজ থেকে শুরু করে শিক্ষা, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি বাজার-সদাই—সব ক্ষেত্রেই এখন অনলাইন সেবার ব্যবহার বাড়ছে। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” স্লোগান শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য নয়; এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মানুষের প্রতিদিনের জীবনে।
তবে এই যাত্রাপথ একেবারেই সহজ নয়। একদিকে যেমন প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, অন্যদিকে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি, ইন্টারনেট বিভ্রাট ও ডিজিটাল বৈষম্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের এই লেখায় আমরা বাংলাদেশের অনলাইন সেবার বর্তমান অবস্থা, এর সুবিধা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বাংলাদেশের অনলাইন সেবার বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে অনলাইন সেবার সূচনা হয়েছিল মূলত মোবাইল ব্যাংকিং ও ই-গভর্নেন্স প্রোগ্রামের মাধ্যমে।
-
ই-গভর্নেন্স: সরকারি সেবা অনলাইনে আনার উদ্যোগে “myGov” পোর্টাল চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে নাগরিকরা জন্মনিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট, জমির খতিয়ান, ট্যাক্স প্রদান ইত্যাদি করতে পারছেন।
-
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS): বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়-এর মতো প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকেও অনলাইন আর্থিক সেবার আওতায় এনেছে।
-
ই-কমার্স: দারাজ, আজকেরডিল, চলোবাজার-এর মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে কেনাকাটা জনপ্রিয় করেছে।
-
স্বাস্থ্যসেবা: করোনাকালে টেলিমেডিসিন অ্যাপ ও “সুরক্ষা” প্ল্যাটফর্ম প্রমাণ করেছে যে প্রযুক্তি কিভাবে জাতীয় সঙ্কটে ভূমিকা রাখতে পারে।
অনলাইন সেবার প্রধান সুবিধা
১. সময় ও খরচ সাশ্রয়
আগে একটি জন্মনিবন্ধন করতে সপ্তাহ লেগে যেত। এখন অনেক ক্ষেত্রেই কয়েক ঘন্টার মধ্যে করা সম্ভব। ব্যাংকে লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর পরিবর্তে মানুষ ঘরে বসেই টাকা পাঠাচ্ছে।
২. গ্রামীণ উন্নয়ন
গ্রামের মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শহরে থাকা আত্মীয়ের টাকা পাচ্ছেন মুহূর্তেই। কৃষকরাও অনলাইন মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করে সরাসরি ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
অনলাইন ট্যাক্স সিস্টেম দুর্নীতি কমিয়েছে। সরকারি দপ্তরে ঘুষ দিয়ে কাজ করার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশের অনলাইন সেবায় বড় চ্যালেঞ্জ
১. ইন্টারনেট গতি ও সংযোগ
ওকলা স্পিড টেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড় মোবাইল ইন্টারনেট স্পিড দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অনেক নিচে। গ্রামে এখনও 4G কাভারেজ সীমিত।
২. সাইবার নিরাপত্তা
বাংলাদেশের মানুষ এখনও ফিশিং, স্ক্যাম ও হ্যাকিং থেকে সুরক্ষিত নয়। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাক দেখিয়েছে কী ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
৩. ডিজিটাল বৈষম্য
ঢাকা ও চট্টগ্রামে যেখানে মানুষ সহজেই ইন্টারনেট পাচ্ছেন, সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো অনেকেই অনলাইন সেবার বাইরে।
৪. দক্ষতার ঘাটতি
অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনও অনলাইন সিস্টেম চালাতে সমস্যায় পড়েন। একইভাবে সাধারণ মানুষও প্রযুক্তি ব্যবহারে অজ্ঞতার কারণে সেবা নিতে অসুবিধায় পড়েন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান
-
ভারত: “ডিজিলকার” ও “আধার” সিস্টেম অনলাইন সেবায় বিপ্লব এনেছে।
-
এস্তোনিয়া: পুরো দেশকে বিশ্বের সবচেয়ে ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ভোট থেকে স্বাস্থ্যসেবা সব অনলাইনে।
-
বাংলাদেশ: এখনও শুরুর পর্যায়ে, তবে জনসংখ্যা ও বাজারের কারণে ভবিষ্যতে এশিয়ার বড় অনলাইন সেবা কেন্দ্র হতে পারে।
সম্ভাবনা
বাংলাদেশের অনলাইন সেবার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।
-
৫জি চালু হলে গতি ও সংযোগ বাড়বে।
-
“স্মার্ট বাংলাদেশ” ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়িত হলে সব নাগরিক সেবা ডিজিটাল হবে।
-
ই-কমার্স, ই-হেলথ, অনলাইন শিক্ষা ও ফ্রিল্যান্সিং দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে।
সমাধানের পথ
-
অবকাঠামো উন্নয়ন: গ্রামে ব্রডব্যান্ড সুবিধা বাড়ানো।
-
সাইবার সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন: ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী সিস্টেম গড়ে তোলা।
-
মানবসম্পদ উন্নয়ন: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা।
-
সাশ্রয়ী ইন্টারনেট: ইন্টারনেট কর ও খরচ কমানো।
উপসংহার
বাংলাদেশের অনলাইন সেবা এখনও শুরুর পথে থাকলেও ভবিষ্যতে এটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। নাগরিকদের আস্থা, প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর বৈশ্বিক মানচিত্রে এক নতুন অবস্থান তৈরি করবে।