
ভূমিকা: ইউরোপে ইতিহাসের ভয়াবহতম দাবানল, এশিয়ায় প্রলয়ঙ্করী বন্যা, আবার আমেরিকায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ—বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমরা চরম আবহাওয়ার খবর পাচ্ছি। একসময় যেগুলোকে বিরল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে মনে করা হতো, সেগুলো এখন যেন এক নতুন স্বাভাবিকতায় (New Normal) পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে যে বিষয়ে সতর্ক করে আসছিলেন, সেই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব এখন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আজকের এই লেখায় আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাম্প্রতিক প্রভাব এবং এর পেছনের কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
জলবায়ু পরিবর্তন কী?
সহজ কথায়, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়াকেই জলবায়ু পরিবর্তন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলা হয়। এর মূল কারণ হলো গ্রিনহাউস গ্যাস, যেমন—কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড। শিল্প কারখানা, যানবাহন, এবং জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাস) পোড়ানোর ফলে এই গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে জমা হয় এবং পৃথিবীর তাপকে বাইরে যেতে বাধা দেয়, অনেকটা গ্রিনহাউসের মতো। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।
চরম আবহাওয়ার সাম্প্রতিক উদাহরণ:
তীব্র দাবদাহ (Heatwaves): গত কয়েক বছরে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রার সম্মুখীন হয়েছে। এই তীব্র গরম কেবল জনজীবনকেই বিপর্যস্ত করে না, বরং এর ফলে দাবানলের ঝুঁকিও বহুগুণে বেড়ে যায়।
অতিবৃষ্টি ও বন্যা: বায়ুমণ্ডল উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে এর জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। এর ফলে অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, যা আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়: সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘূর্ণিঝড় বা হারিকেনগুলো আরও শক্তিশালী এবং বিধ্বংসী হয়ে উঠছে।
খরা: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনেও পরিবর্তন আসছে, যার ফলে বিশ্বের অনেক অঞ্চল, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদী খরার কবলে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর।
এর প্রভাব কাদের উপর বেশি? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি দায়ী হলেও এর সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং নিচু উপকূলীয় দেশগুলো। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিশাল অংশ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে এবং সুপেয় পানির অভাব দেখা দিচ্ছে।
আমাদের করণীয় কী? এই সংকট মোকাবিলায় ব্যক্তিগত এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়েই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ:
অনুযায়ী, বিশ্বের দেশগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে, বিশেষভাবে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হয়েছে। এর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি (সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি) ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে হবে।প্যারিস চুক্তি ব্যক্তিগত পদক্ষেপ: আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে অবদান রাখতে পারি। বিদ্যুৎ ও পানির অপচয় কমানো, প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাস করা, গাছ লাগানো এবং গণপরিবহন ব্যবহার করার মতো ছোট ছোট পদক্ষেপও সম্মিলিতভাবে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
উপসংহার: জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কা নয়, এটি আমাদের বর্তমানের এক কঠিন বাস্তবতা। এর প্রভাব মোকাবিলায় এখনই যদি আমরা সচেতন এবং সক্রিয় না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি বসবাস অযোগ্য পৃথিবী রেখে যাব। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল এই বৈশ্বিক সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।