পাঁচ বছর। পাক্কা পাঁচটি বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখার মুহূর্তটা ছিল অদ্ভুত। এয়ারপোর্টের সেই পরিচিত গন্ধ, ইমিগ্রেশন অফিসারের বাংলা সম্ভাষণ, বাইরে অপেক্ষারত মানুষের কোলাহল—সবকিছু ঠিক আগের মতোই ছিল, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল এই চেনা পরিবেশের সাথে আমি বড্ড অচেনা। হয়তো আমিই বদলে গেছি, কিংবা বদলে গেছে আমার শহর।
গাড়িটা যখন এয়ারপোর্ট থেকে বাসার দিকে ছুটছিল, আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে, চেনা দোকানটার জায়গায় এখন এক চকচকে কফি শপ। ট্র্যাফিক জ্যামটা আগের মতোই ভয়াবহ, কিন্তু হর্নের শব্দগুলো এখন যেন কানের ভেতর আরও তীব্রভাবে বিঁধছে। কুয়েতের গোছানো, শান্ত রাস্তার পর ঢাকার এই বিশৃঙ্খলাকে আলিঙ্গন করতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে মনে নিজেকে বললাম, "এটাই তো আমার শহর, এখানেই তো আমার শেকড়। মানিয়ে নিতে হবে।"
বাসায় পৌঁছানোর পর শুরু হলো আরেক অধ্যায়। মা আমার পছন্দের সব খাবার রান্না করেছেন। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে অলিভ অয়েল আর কম মশলার খাবারে অভ্যস্ত জিহ্বাটা যেন দেশি খাবারের তীব্র স্বাদ আর তেলের আধিক্য নিতে পারছিল না। সবাই যখন আমার বিদেশ জীবনের গল্প শুনতে ব্যস্ত, আমি তখন ভাবছিলাম কীভাবে এখানকার সবকিছুর সাথে নিজেকে আবার খাপ খাওয়াব। পুরনো বন্ধুরা দেখা করতে এলো। তাদের আড্ডার বিষয়বস্তু, হাসি-ঠাট্টার ধরণ, এমনকি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোও আমার থেকে অনেকটাই আলাদা। তারা দেশের রাজনীতি, ক্রিকেট আর শেয়ার বাজার নিয়ে উত্তেজিত, আর আমি ভাবছি আমার পরবর্তী প্রজেক্টের ডেডলাইন আর কুয়েতের ড্রাইভিং লাইসেন্স রিনিউ করার কথা। তাদের কথার মাঝে নিজেকে বড্ড বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল। আমি হাসার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সেই হাসিটা যেন ভেতর থেকে আসছিল না।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম যখন বুঝলাম, আমি যাদের জন্য এতকিছু ত্যাগ করে বিদেশে পড়ে আছি, সেই প্রিয় মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবন থেকেও আমি কতটা দূরে সরে গেছি। আমার ছোট বোনটা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তার নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়েছে। বাবা-মায়ের শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। এই পাঁচ বছরে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট-বড় অসংখ্য ঘটনার আমি কেবল একজন শ্রোতা, কোনো অংশীদার নই। এই উপলব্ধিটা বুকের ভেতর একটা গভীর শূন্যতা তৈরি করে দিল।
বিদেশে থাকার সময় প্রতি মুহূর্তে দেশের জন্য মন কাঁদে। আমরা ভাবি, একবার দেশে ফিরতে পারলেই সব কষ্ট ভুলে যাব। কিন্তু ফেরার পর যখন দেখি, যে দেশের জন্য এত আকুলতা, সেই দেশেই নিজেকে একজন বহিরাগতের মতো লাগছে, তখন যে অনুভূতিটা হয়, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় তাকেই বলে "রিভার্স কালচার শক"। এটা অনেকটা নিজের বাড়িতেই অতিথি হয়ে থাকার মতো। আপনি সবকিছু দেখছেন, বুঝছেন, কিন্তু কোনো কিছুর সাথে নিজেকে মেলাতে পারছেন না। আপনার চিন্তা-ভাবনা, অভ্যাস, এমনকি সময়ানুবর্তিতার ধারণাটাও বদলে গেছে, যা আপনার চারপাশের মানুষের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে।
এই বিচ্ছিন্নতা, এই পরিচয় সংকট—এটা প্রবাস জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা, যার জন্য আমরা অনেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি না। এটা কোনো অসুখ নয়, এটা একটা সাময়িক অবস্থা। পুরনো সম্পর্কগুলোকে নতুন করে ঝালিয়ে নিতে, বদলে যাওয়া পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে। প্রয়োজন হয় ধৈর্য আর কাছের মানুষদের সাথে খোলামেলা আলোচনার।
এক মাস পর যখন ফেরার জন্য আবার এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলাম, তখন মনে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। একদিকে কুয়েতের গোছানো জীবনের প্রতি টান, অন্যদিকে ফেলে যাওয়া এই চেনা শহরের জন্য মায়া। হয়তো প্রবাসীদের জীবনটাই এমন। তাদের দুটি বাড়ি থাকে, কিন্তু কোনোটিই পুরোপুরি তাদের হয় না। তারা অনেকটা শেকড় ছেঁড়া গাছের মতো, যা নতুন মাটিতে বেড়ে উঠলেও পুরনো মাটির জন্য আজীবন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে।
