গিগ ইকোনমি: স্বাধীনতার হাতছানি নাকি অনিশ্চয়তার চোরাবালি?

0


ঢাকার রাস্তায় ছুটে চলা ফুড ডেলিভারি রাইডার, যিনি আপনার জন্য গরম খাবার নিয়ে আসছেন, অথবা নিউইয়র্কের একজন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার, যিনি বিশ্বের অন্য প্রান্তের কোনো ক্লায়েন্টের জন্য লোগো ডিজাইন করছেন—তাদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনো মিল না থাকলেও, তারা উভয়েই এক বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক ধারার অংশ। এর নাম গিগ ইকোনমি (Gig Economy)। প্রথাগত ৯টা-৫টার চাকরির বাইরে, এই অর্থনীতি মানুষকে নিজের সময় এবং দক্ষতার উপর ভিত্তি করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। উবার, পাঠাও, ফুডপ্যান্ডা থেকে শুরু করে আপওয়ার্ক, ফাইভারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু এই স্বাধীনতার পেছনে কি লুকিয়ে আছে এক গভীর অনিশ্চয়তা? গিগ ইকোনমি কি সত্যিই কর্মীদের মুক্তি দিচ্ছে, নাকি তাদের এক নতুন ধরনের শোষণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

স্বাধীনতার হাতছানি: কেন জনপ্রিয় হচ্ছে গিগ ওয়ার্ক?

গিগ ইকোনমির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হলো এর দেওয়া নমনীয়তা (Flexibility)। কর্মীরা তাদের নিজেদের বস। কখন কাজ করবেন, কতক্ষণ কাজ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নিতে পারেন। একজন ছাত্র তার ক্লাসের ফাঁকে রাইড শেয়ার করে বাড়তি আয় করতে পারেন, একজন গৃহিণী তার সংসারের কাজের পাশাপাশি অনলাইনে লেখালেখি করে স্বাবলম্বী হতে পারেন। এখানে কোনো অফিসের ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, বসের জবাবদিহিতা নেই। নিজের দক্ষতা বিক্রি করে সরাসরি আয় করার এই মডেলটি তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মডেলে কাজ করে তাদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করছে এবং প্রথাগত চাকরির বাজারের উপর চাপ কমাচ্ছে।

অনিশ্চয়তার চোরাবালি: স্বাধীনতার পেছনের কঠিন বাস্তবতা

চকচকে মোড়কের আড়ালে গিগ ইকোনমির একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। এই মডেলের কর্মীরা কোম্পানির সরাসরি কর্মী হিসেবে বিবেচিত হন না, তারা 'স্বাধীন ঠিকাদার' (Independent Contractor) হিসেবে পরিচিত। এর ফলে তারা প্রথাগত কর্মীদের মতো কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান না।

  • চাকরির নিরাপত্তা নেই: আজ কাজ আছে, কাল নাও থাকতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বেতনের নিশ্চয়তা নেই। আয় সম্পূর্ণভাবে কাজের প্রাপ্যতার উপর নির্ভরশীল।

  • স্বাস্থ্য বিমা ও ছুটির অভাব: অসুস্থ হলে বা কোনো জরুরি প্রয়োজনে ছুটি নিলে তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। প্রথাগত চাকরির মতো স্বাস্থ্য বিমা, সবেতন ছুটি (Paid Leave) বা ভবিষ্যৎ তহবিল (Provident Fund)-এর মতো কোনো সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের জন্য থাকে না।

  • ন্যূনতম মজুরির অনিশ্চয়তা: অনেক প্ল্যাটফর্মেই কর্মীদের আয়ের কোনো ন্যূনতম নিশ্চয়তা দেওয়া হয় না। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে অনেক সময় খুবই কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়। ফুড ডেলিভারি বা রাইড শেয়ারিং কর্মীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও আশানুরূপ আয় না হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটে।

  • একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ: প্রথাগত অফিসের মতো সহকর্মীদের সাথে মেলামেশার সুযোগ না থাকায় অনেক গিগ কর্মী একাকীত্বে ভোগেন। আয়ের অনিশ্চয়তা এবং ক্রমাগত ভালো রেটিং ধরে রাখার চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিশ্বজুড়ে এখন এই নিয়ে বিতর্ক চলছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মতো কিছু জায়গায় আইন করে উবারের চালকদের কোম্পানির কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে গিগ কর্মীদের অধিকার এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠছে। কোম্পানিগুলো বলছে, কর্মীদের সুবিধা দিলে তাদের ব্যবসার মডেলটিই ভেঙে পড়বে, যার ফলে সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, শ্রমিক অধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রযুক্তির নামে কর্মীদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এক ধরনের শোষণ।

গিগ ইকোনমি নিঃসন্দেহে আমাদের কাজের জগতকে বদলে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। এটি একদিকে যেমন নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনই তৈরি করেছে নতুন চ্যালেঞ্জ। এই মডেলটিকে কীভাবে আরও মানবিক এবং টেকসই করা যায়, যেখানে কর্মীর স্বাধীনতা এবং অধিকার উভয়ই সুরক্ষিত থাকবে—সেটিই এখন বিশ্বজুড়ে নীতি নির্ধারক, কোম্পানি এবং কর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!