কুয়েতে সপ্তাহান্ত মানেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত একরাশ অবসর। সপ্তাহের পাঁচ দিনের কঠোর পরিশ্রমের পর এই সময়টুকু কীভাবে কাটাবেন, তা নিয়ে অনেক প্রবাসীই দ্বিধায় পড়েন। অনেকেই হয়তো রুমের ভেতরে বা শপিং মলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেই এই সময়টা কাটিয়ে দেন। কিন্তু এই ছোট দেশটার বুকেও লুকিয়ে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিনোদন এবং প্রকৃতির এমন সব রত্ন, যা আপনার সপ্তাহান্তকে করে তুলতে পারে অবিস্মরণীয়।
এই পোস্টে আমরা কোনো একটি জায়গার বর্ণনা দেব না। আমরা আপনার জন্য তিনটি ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন বাজেটের এবং ভিন্ন রুচির মানুষের জন্য একটি সম্পূর্ণ সাপ্তাহিক ভ্রমণ পরিকল্পনা বা 'আইটিনেরারি' তৈরি করে দেব। আপনি একজন সংস্কৃতিপ্রেমী হোন, পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চান, বা বন্ধুদের সাথে স্বল্প খরচে মজা করতে চান—এই গাইডটিতে প্রত্যেকের জন্যই কিছু না কিছু রয়েছে।
ভ্রমণ পরিকল্পনা ১: সংস্কৃতি ও ইতিহাস প্রেমীদের জন্য ("দ্য কালচারাল এক্সপ্লোরার")
উদ্দেশ্য: কুয়েতের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আধুনিক স্থাপত্যের গভীরে প্রবেশ করা।
বাজেট: মাঝারি।
উপযুক্ত: একক প্রবাসী, দম্পতি বা ছোট গ্রুপ।
শুক্রবার:
সকাল ৯:০০ - দুপুর ১২:০০: কুয়েত টাওয়ারস এবং গ্র্যান্ড মস্ক পরিদর্শন
আপনার সকাল শুরু করুন কুয়েতের সবচেয়ে আইকনিক ল্যান্ডমার্ক, কুয়েত টাওয়ারস দিয়ে। এই তিনটি নীলচে-সবুজ টাওয়ার কেবল একটি ওয়াটার রিজার্ভারই নয়, এটি আধুনিক কুয়েতের প্রতীক। মূল টাওয়ারের ১২৩ মিটার উঁচু ভিউয়িং স্ফিয়ারে উঠে আপনি পুরো কুয়েত সিটি এবং আরব উপসাগরের একটি ৩৬০-ডিগ্রি প্যানোরামিক ভিউ উপভোগ করতে পারবেন। প্রবেশমূল্য সাধারণত ৩ কুয়েতি দিনার।
এরপর, সেখান থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত গ্র্যান্ড মস্ক অফ কুয়েত-এর দিকে এগিয়ে যান। এটি দেশের বৃহত্তম মসজিদ এবং ইসলামিক স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময়ে অমুসলিম দর্শনার্থীদের জন্য গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা থাকে (বিনামূল্যে)। এর বিশাল গম্বুজ, জটিল কারুকাজ এবং শান্ত পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। (দ্রষ্টব্য: পরিদর্শনের জন্য মার্জিত পোশাক পরা আবশ্যক)।
দুপুর ১:০০ - বিকাল ৪:০০: সুক মুবারাকিয়ায় মধ্যাহ্নভোজ এবং কেনাকাটা
দুপুরের খাবারের জন্য এবং কুয়েতের আসল ঐতিহ্য অনুভব করার জন্য সুক মুবারাকিয়া-র কোনো বিকল্প নেই। এটি কুয়েতের সবচেয়ে পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী বাজার। এখানকার কোনো একটি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় বসে পড়ুন এবং ঐতিহ্যবাহী কুয়েতি খাবার, যেমন—মাছবুস বা মুতাব্বাক সামাক-এর স্বাদ নিন।
খাওয়ার পর, বাজারের অলিগলিতে হারিয়ে যান। এখানে আপনি খেজুর, মশলা, পারফিউম (আতর), ঐতিহ্যবাহী পোশাক (দিশদাশা), এবং বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিক জিনিস খুঁজে পাবেন। দর কষাকষি এখানকার কেনাকাটার একটি অন্যতম অংশ।
সন্ধ্যা ৭:০০ - রাত ১০:০০: আল শহীদ পার্কে লেজার শো এবং রাতের কফি
আপনার দিনের শেষটা করুন কুয়েত সিটির ফুসফুস, আল শহীদ পার্ক-এ। এটি কেবল একটি পার্ক নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সন্ধ্যার পর এখানকার মিউজিক্যাল ফাউন্টেন এবং লেজার শো এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করে। পার্কের ভেতরে থাকা কোনো একটি আধুনিক ক্যাফেতে বসে এক কাপ কফি হাতে দিনের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে পারেন।
শনিবার:
সকাল ১০:০০ - দুপুর ১:০০: তারিক রজব মিউজিয়াম অফ ইসলামিক আর্ট
জাবরিয়া এলাকায় অবস্থিত এই ব্যক্তিগত জাদুঘরটি ইসলামিক শিল্পকলার এক অমূল্য ভান্ডার। এখানে আপনি প্রাচীন কোরআনের পান্ডুলিপি, হাতে তৈরি গহনা, সিরামিক এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাকের এক বিশাল সংগ্রহ দেখতে পাবেন। এটি আপনাকে কুয়েত এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের শৈল্পিক ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
দুপুর ২:০০ - সন্ধ্যা ৬:০০: দ্য সায়েন্টিফিক সেন্টার
সালমিয়ার সমুদ্রের তীরে অবস্থিত দ্য সায়েন্টিফিক সেন্টার কুয়েতের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। এখানকার অ্যাকোয়ারিয়ামটি মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম, যেখানে আপনি আরব মরুভূমি এবং সামুদ্রিক অঞ্চলের বিচিত্র প্রাণিজগৎ দেখতে পাবেন। এছাড়াও রয়েছে একটি IMAX থিয়েটার, যেখানে শিক্ষামূলক থ্রিডি মুভি দেখানো হয়।
ভ্রমণ পরিকল্পনা ২: পরিবার এবং বাচ্চাদের জন্য ("দ্য ফ্যামিলি ফান উইকেন্ড")
উদ্দেশ্য: বাচ্চাদের জন্য একটি আনন্দময় এবং শিক্ষামূলক সপ্তাহান্ত কাটানো।
বাজেট: মাঝারি থেকে উচ্চ।
শুক্রবার:
সকাল ১০:০০ - সন্ধ্যা পর্যন্ত: দ্য অ্যাভিনিউজ মল
দ্য অ্যাভিনিউজ মল কেবল একটি শপিং মল নয়, এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিনোদন কেন্দ্র। আপনার পুরো দিনটি আপনি এখানেই কাটাতে পারেন।
বাচ্চাদের জন্য: এখানে রয়েছে 'ম্যাজিক প্ল্যানেট' এবং 'কিডজেনিয়া'-র মতো বিশাল ইনডোর থিম পার্ক। কিডজেনিয়াতে বাচ্চারা বিভিন্ন পেশার (যেমন: ডাক্তার, ফায়ার ফাইটার) ভূমিকা পালন করে খেলার ছলে শিখতে পারে।
খাওয়া-দাওয়া: মলের ভেতরে শত শত রেস্তোরাঁ এবং ফুড কোর্ট রয়েছে, যা সব ধরনের বাজেট এবং রুচির সাথে খাপ খায়।
কেনাকাটা এবং সিনেমা: বিশ্বের প্রায় সব বড় ব্র্যান্ডের দোকান এখানে রয়েছে। দিনশেষে, всей семьей একটি নতুন মুভি দেখে আপনার দিনটি শেষ করতে পারেন।
শনিবার:
সকাল ৯:০০ - দুপুর ২:০০: কুয়েত চিড়িয়াখানা
ওমারিয়া এলাকায় অবস্থিত কুয়েত চিড়িয়াখানা বাচ্চাদের জন্য একটি দারুণ আকর্ষণের জায়গা। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং পাখি রয়েছে।
বিকাল ৪:০০ - সন্ধ্যা ৭:০০: মেসিলাহ বিচে অবসর
মেসিলাহ বিচ হলো কুয়েতের অন্যতম জনপ্রিয় এবং পরিচ্ছন্ন পাবলিক বিচ। এখানে বাচ্চাদের খেলার জায়গা, সুইমিং পুল এবং ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা রয়েছে। সমুদ্রের তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতাটি অসাধারণ।
ভ্রমণ পরিকল্পনা ৩: স্বল্প খরচে বন্ধুদের সাথে ("দ্য বাজেট অ্যাডভেঞ্চার")
উদ্দেশ্য: খুব কম খরচে কুয়েতকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা এবং বন্ধুদের সাথে মজা করা।
বাজেট: নিম্ন।
শুক্রবার:
সকাল ৭:০০ - দুপুর ১২:০০: ক্রিকেট এবং কমিউনিটি বন্ডিং
আপনার সকাল শুরু করুন কাছাকাছি কোনো খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলে। এটি বিনোদনের পাশাপাশি কমিউনিটির অন্যান্যদের সাথে মিশে যাওয়ার সেরা উপায়।
দুপুর ১:০০ - বিকাল ৩:০০: জিলিব বা ফারওয়ানিয়ার স্থানীয় রেস্তোরাঁয় ভোজ
বড় শপিং মলের ফুড কোর্ট এড়িয়ে, জিলিব আল-শুয়েখ বা ফারওয়ানিয়ার মতো প্রবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় চলে যান। এখানকার স্থানীয় বাংলাদেশি বা ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোতে আপনি অত্যন্ত কম খরচে সুস্বাদু এবং ঘরোয়া খাবারের স্বাদ পাবেন।
বিকাল ৪:০০ - রাত ৮:০০: পাবলিক বাসে শহর ভ্রমণ
একটি বাস কার্ড রিচার্জ করে নিন এবং কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই একটি KPTC বা CityBus-এ উঠে পড়ুন। বাসের জানালা দিয়ে আপনি এমন সব এলাকা এবং জীবনযাত্রা দেখতে পাবেন, যা সাধারণত চোখে পড়ে না। এটি কুয়েতকে তার আসল রূপে দেখার সবচেয়ে সস্তা এবং খাঁটি উপায়।
শনিবার:
বিকাল ৩:০০ - সন্ধ্যা ৭:০০: ফিশ মার্কেট এবং সমুদ্র তীর
কুয়েত সিটির শার্ক এলাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় ফিশ মার্কেট বা মাছের বাজারে ঘুরে আসুন। এখানে সমুদ্র থেকে ধরে আনা তাজা মাছ এবং সামুদ্রিক প্রাণীর বিশাল সমাহার দেখতে পাবেন।
ফিশ মার্কেটের পাশেই রয়েছে সমুদ্রের তীর। সেখানে বসে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে এবং সূর্যাস্ত দেখে আপনার সপ্তাহান্তটি শেষ করতে পারেন।
এই পরিকল্পনাগুলো কেবল একটি সূচনা মাত্র। কুয়েতের প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে নতুন কিছু আবিষ্কার করার সুযোগ। তাই, পরের সপ্তাহান্তে আর রুমে বসে না থেকে, বেরিয়ে পড়ুন আপনার শহরকে নতুন করে ভালোবাসতে।