প্রবাসে মানসিক স্বাস্থ্য: নীরব মহামারী এবং উত্তরণের উপায়

0



বিশেষ প্রতিবেদন, ২২ সেপ্টেম্বর: 

সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম), কুয়েতের একটি নির্মাণ কোম্পানিতে কর্মরত একজন ফোরম্যান। বয়স ৩৫। দেশে স্ত্রী এবং দুই সন্তান রেখে এসেছেন পাঁচ বছর আগে। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা ডিউটি শেষে যখন মেসে ফেরেন, তখন তার পৃথিবীটা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় একটি ছোট বিছানা আর একটি স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। তিনি যখন দেশে ফোন করেন, তখন তার কণ্ঠস্বর থাকে হাসিখুশি। কিন্তু ফোনের লাইনটা কেটে দেওয়ার পর, এক তীব্র বিষণ্ণতা এবং শূন্যতা তাকে গ্রাস করে। তিনি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারেন না, এবং প্রায়শই একা একা কাঁদেন। সাইফুল ইসলাম একা নন। তিনি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি প্রবাসীর সেই নীরব মহামারীর একজন শিকার, যার নাম 'মানসিক স্বাস্থ্য সংকট'।

প্রবাস জীবনকে প্রায়শই অর্থনৈতিক সাফল্যের মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। কিন্তু এই সাফল্যের আড়ালে যে মানসিক মূল্যে চুকাতে হয়, তা প্রায়শই অলিখিত এবং উপেক্ষিত থেকে যায়। এই প্রতিবেদনে আমরা প্রবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের মূল কারণগুলো, এর প্রভাব এবং এই নীরব মহামারী থেকে বেরিয়ে আসার উপায়গুলো নিয়ে একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরব।

কেন প্রবাসীরা এত ঝুঁকিপূর্ণ? (The Risk Factors) মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রবাসীরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। এর পেছনে একাধিক কারণ জড়িত।

  • বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব: এটিই সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী কারণ। পরিবার, বন্ধু এবং নিজের চেনা সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নতুন এবং অপরিচিত পরিবেশে বাস করাটা মনের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই একাকীত্ব থেকে জন্ম নেয় বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ।

  • সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বাধা: নতুন দেশের সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং ভাষার সাথে মানিয়ে নিতে না পারাটা একজন মানুষকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে তোলে। স্থানীয়দের সাথে মিশতে না পারার কারণে তারা নিজেদের একটি অদৃশ্য খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নেয়।

  • অকল্পনীয় কাজের চাপ এবং শোষণ: অনেক প্রবাসীই দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, নিম্ন মজুরি এবং অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হন। শারীরিক ক্লান্তির সাথে সাথে এই শোষণ তাদের মানসিক শক্তিকেও নিঃশেষ করে দেয়।

  • আর্থিক চাপ এবং পরিবারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা: প্রবাসীরা প্রায়শই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হন। দেশে থাকা পরিবারের চাহিদা মেটানো, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, এবং ঋণের বোঝা—এই constante আর্থিক চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তারা নিজেদের অসুস্থতা বা প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে কেবল টাকা পাঠানোর যন্ত্রে পরিণত হন।

  • পরিচয় সংকট: দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে থাকার পর, অনেক প্রবাসীই এক ধরনের পরিচয় সংকটে ভোগেন। তারা না পারেন নতুন দেশকে পুরোপুরি আপন করে নিতে, না পারেন দেশের সাথে আগের মতো সংযোগ অনুভব করতে।

নীরবতার সংস্কৃতি এবং সাহায্যের অভাব এই সমস্যাগুলো থাকা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ প্রবাসীই তাদের মানসিক কষ্ট নিয়ে কথা বলতে চান না।

  • 'পুরুষ মানুষ কাঁদে না'—এই সামাজিক ট্যাবু: বিশেষ করে পুরুষ প্রবাসীদের মধ্যে এই ধারণাটি প্রবল যে, মানসিক কষ্টের কথা বলাটা এক ধরনের দুর্বলতার লক্ষণ। তারা তাদের আবেগগুলোকে চেপে রাখতে শেখেন।

  • পরিবারকে চিন্তায় ফেলার ভয়: তারা দেশে থাকা পরিবারকে তাদের কষ্টের কথা জানাতে চান না, কারণ তারা ভয় পান যে এতে পরিবার আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়বে।

  • সাহায্যের অপ্রতুলতা: বেশিরভাগ দেশেই, প্রবাসীদের জন্য সাশ্রয়ী এবং তাদের ভাষায় কথা বলতে পারে এমন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই কম। তথ্যের অভাবে, অনেকেই জানেন না যে, সাহায্যের জন্য কোথায় যেতে হবে।

এই নীরবতার সংস্কৃতিই সমস্যাটিকে একটি মহামারীর রূপ দিয়েছে। চেপে রাখা আবেগগুলো একসময় বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, অনিদ্রা, এবং গুরুতর ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো ট্র্যাজেডির দিকে ঠেলে দেয়।

উত্তরণের পথ—কীভাবে ভালো থাকবেন? মানসিক স্বাস্থ্য সংকট একটি বাস্তব সমস্যা, এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

  • প্রথম পদক্ষেপ: স্বীকার করা এবং কথা বলা:

    • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম ধাপটি হলো, নিজের সমস্যাটিকে স্বীকার করা। "আমি ভালো নেই"—এই কথাটি নিজেকে এবং অন্যকে বলতে পারাটা সাহসের পরিচয়।

    • আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু বা সহকর্মীর সাথে আপনার অনুভূতিগুলো শেয়ার করুন। কথা বললে মনের ভার অর্ধেক কমে যায়।

  • দ্বিতীয় পদক্ষেপ: একটি রুটিন তৈরি করুন:

    • প্রবাসের বিশৃঙ্খল জীবনে একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করাটা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো এবং ঘুম থেকে ওঠা, নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া—এই ছোট ছোট বিষয়গুলো আপনার জীবনে এক ধরনের শৃঙ্খলা এবং নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনবে।

  • তৃতীয় পদক্ষেপ: শারীরিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন:

    • শরীর এবং মনের মধ্যে একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম 'এন্ডোরফিন' নামক হরমোন নিঃসরণ করে, যা স্বাভাবিকভাবেই মনকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।

    • স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার গ্রহণ করুন।

  • চতুর্থ পদক্ষেপ: সংযোগ স্থাপন করুন:

    • নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখবেন না। ছুটির দিনে বাইরে যান, নতুন মানুষের সাথে মিশুন। আপনার দেশের কমিউনিটি গ্রুপগুলোর অনুষ্ঠানে যোগ দিন।

    • একটি শখ বা হবি তৈরি করুন। খেলাধুলা, বাগান করা, বা ছবি আঁকা—যেকোনো কিছু, যা আপনাকে আনন্দ দেয় এবং আপনাকে ব্যস্ত রাখে।

  • পঞ্চম পদক্ষেপ: পেশাদার সাহায্য নিন:

    • যদি আপনার বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে পেশাদার সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। অনেক দেশে এখন বিভিন্ন এনজিও এবং দূতাবাস প্রবাসীদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করে। অনলাইনেও এখন অনেক মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য পাওয়া যায়।

আপনার মানসিক স্বাস্থ্য আপনার শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকেন, তাহলে আপনি আপনার পরিবারের জন্যও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। প্রবাস জীবন একটি কঠিন সংগ্রাম, কিন্তু এই সংগ্রামে আপনাকে একা লড়তে হবে না। সঠিক যত্ন, সচেতনতা এবং প্রয়োজনে সাহায্য চাওয়ার মাধ্যমে, এই নীরব মহামারীকে জয় করা সম্ভব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!