কেন বাংলাদেশ হতে পারে পরবর্তী টেক জায়ান্ট: একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টের বিনিয়োগ থিসিস

0



ডকুমেন্টের ধরণ: ইনভেস্টমেন্ট থিসিস (Investment Thesis) বিষয়: বাংলাদেশের উদীয়মান স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে কৌশলগত বিনিয়োগের যৌক্তিকতা। ফার্ম: প্রগতি ভেঞ্চারস (কাল্পনিক)

১. নির্বাহী সারসংক্ষেপ: একটি চাপা গর্জন বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা যখন ভারত, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো প্রতিষ্ঠিত বাজারগুলো নিয়ে ব্যস্ত, তখন দক্ষিণ এশিয়ার বুকে এক নতুন বাঘ নীরবে তার শক্তি সঞ্চয় করছে—বাংলাদেশ। ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার এই দেশটি এখন আর কেবল তৈরি পোশাক বা রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল একটি অর্থনীতি নয়। এটি এক দ্রুত বর্ধনশীল ডিজিটাল অর্থনীতি, যার নেতৃত্বে রয়েছে একদল তরুণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং প্রযুক্তি-সচেতন উদ্যোক্তা।

প্রগতি ভেঞ্চারস-এর এই থিসিসটি যুক্তি দিচ্ছে যে, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা, ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি এবং বাজারের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর এক অনন্য সমন্বয়ের কারণে, বাংলাদেশ বর্তমানে প্রারম্ভিক পর্যায়ের (Early-stage) প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দশকে, বাংলাদেশ থেকে একাধিক 'ইউনিকর্ন' (১ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের কোম্পানি) এবং আঞ্চলিক টেক জায়ান্টের জন্ম হবে।

২. ম্যাক্রো-ইকোনমিক চালিকাশক্তি (Macroeconomic Tailwinds): যে বাতাস আমাদের পালে লাগবে

  • জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ডিভিডেন্ড: বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ (প্রায় ৬৫%) ২৫ বছরের কম বয়সী। এই তরুণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীই হলো যেকোনো ডিজিটাল অর্থনীতির মূল চালক। তারা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে এবং অনলাইন পরিষেবা ব্যবহার করতে অত্যন্ত আগ্রহী।

  • অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি: গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ৬-৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নতুন নতুন ডিজিটাল সেবার জন্য একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করছে।

  • ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি: সরকারের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এবং পরবর্তী 'স্মার্ট বাংলাদেশ' উদ্যোগের ফলে, দেশে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিস্ফোরক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS)-এর অবিশ্বাস্য সাফল্য প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ প্রযুক্তিগত সমাধান গ্রহণ করতে প্রস্তুত, যদি তা তাদের জীবনকে সহজ করে তোলে।

৩. কৌশলগত খাত বিশ্লেষণ: কোথায় লুকিয়ে আছে আসল সুযোগ?

আমরা বিনিয়োগের জন্য নিম্নলিখিত খাতগুলোকে সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করেছি:

  • ফিনটেক (FinTech):

    • প্রতিষ্ঠিত ভিত্তি: বিকাশ এবং নগদের মতো MFS প্ল্যাটফর্মগুলো ইতিমধ্যেই আর্থিক লেনদেনের একটি শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি করে দিয়েছে।

    • ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: এই ভিত্তির উপর ভিত্তি করে, ঋণ (Micro-lending), বীমা (Insurtech), ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা (Personal Finance Management) এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট সলিউশনের ক্ষেত্রে বিশাল সুযোগ রয়েছে। দেশের একটি বড় অংশ এখনও প্রথাগত ব্যাংকিং-এর বাইরে থাকায়, ফিনটেক স্টার্টআপগুলোর জন্য বাজারটি প্রায় অবারিত।

  • লজিস্টিকস এবং ই-কমার্স (Logistics & E-commerce):

    • বর্তমান অবস্থা: দারাজ এবং চালডালের মতো কোম্পানিগুলো ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেছে। তবে, লজিস্টিকস, বিশেষ করে 'লাস্ট-মাইল ডেলিভারি', এখনও এই খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

    • বিনিয়োগের সুযোগ: যে সব স্টার্টআপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওয়্যারহাউস ম্যানেজমেন্ট, ইনভেন্টরি কন্ট্রোল এবং ডেলিভারি প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারবে (যেমন: Pathao), তাদের জন্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা অপরিসীম। হাইপারলোকাল ডেলিভারি এবং কৃষি-ভিত্তিক ই-কমার্সেও বড় সুযোগ রয়েছে।

  • এডুটেক (Ed-Tech) এবং হেলথটেক (Health-tech):

    • অনুঘটক: কোভিড-১৯ মহামারী এই দুটি খাতের প্রয়োজনীয়তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

    • সুযোগ: মানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা—এই দুটিই বাংলাদেশের বড় সমস্যা। যে সব স্টার্টআপ অনলাইন কোর্স, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, টেলিমেডিসিন, বা অনলাইন ফার্মেসি সেবা প্রদান করবে, তাদের জন্য একটি বিশাল এবং ক্রমবর্ধমান বাজার অপেক্ষা করছে।

  • সফটওয়্যার অ্যাজ এ সার্ভিস (SaaS):

    • বাজার: বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (SME) এখনও তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম (হিসাবরক্ষণ, ইনভেন্টরি, এইচআর) পুরনো পদ্ধতিতে পরিচালনা করে।

    • সুযোগ: এই ব্যবসাগুলোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা, সাশ্রয়ী এবং সহজবোধ্য ক্লাউড-ভিত্তিক SaaS সলিউশনের একটি বিশাল চাহিদা রয়েছে।

৪. ইকোসিস্টেমের পরিপক্কতা: সাফল্যের জন্য প্রস্তুত ক্ষেত্র

  • প্রতিভার বিকাশ: দেশীয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এখন বিশ্বমানের প্রযুক্তিগত প্রতিভা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক তরুণই এখন সিলিকন ভ্যালি বা অন্যান্য টেক হাব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে এসে নিজের স্টার্টআপ তৈরি করছে।

  • সরকারি সহায়তা: সরকারের 'স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড' নামক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড, হাই-টেক পার্ক নির্মাণ এবং নীতিগত সহায়তা ইকোসিস্টেমের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করছে।

  • বিনিয়োগের আগমন: যদিও এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, স্থানীয় অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর নেটওয়ার্ক এবং আন্তর্জাতিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মগুলো ধীরে ধীরে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।

৫. ঝুঁকি মূল্যায়ন (Risk Assessment):

কোনো উদীয়মান বাজারই ঝুঁকিমুক্ত নয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও কিছু ঝুঁকি রয়েছে:

  • নীতিমালাগত অনিশ্চয়তা: দ্রুত পরিবর্তনশীল সরকারি নীতিমালা অনেক সময় ব্যবসার জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

  • অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: স্থিতিশীল ইন্টারনেট এবং লজিস্টিকস এখনও দেশের অনেক অংশে একটি চ্যালেঞ্জ।

  • এক্সিট স্ট্র্যাটেজির অভাব: বর্তমানে, আইপিও (IPO) বা বড় কোম্পানির দ্বারা অধিগ্রহণ (Acquisition)-এর মতো 'এক্সিট' সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।

৬. চূড়ান্ত থিসিস এবং বিনিয়োগের আহ্বান:

উপরে উল্লিখিত চালিকাশক্তি এবং সুযোগগুলো বিশ্লেষণ করে, প্রগতি ভেঞ্চারস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম একটি 'ইনফ্লেকশন পয়েন্ট' বা সন্ধিক্ষণে রয়েছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলো এই ঝুঁকিগুলোকে অতিক্রম করে।

আমাদের বিনিয়োগ থিসিস হলো: ফিনটেক, লজিস্টিকস, এডুটেক এবং হেলথটেক খাতে, শক্তিশালী এবং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে নিবেদিত প্রতিষ্ঠাতা-দলসহ প্রারম্ভিক পর্যায়ের স্টার্টআপগুলোতে কৌশলগতভাবে বিনিয়োগ করা। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে, এই বিনিয়োগগুলো অসাধারণ রিটার্ন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং একই সাথে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে একটি অর্থবহ ভূমিকা পালন করবে।

এখনই সময় বাংলাদেশের এই চাপা গর্জনে বিনিয়োগ করার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!