বিকেল বেলা, গ্রামে হাট থেকে ফেরার সময় হাবু মিয়া হঠাৎ এক দোকানে চোখে পড়ল একটা ঝকঝকে সাইকেল। নতুন না, তবে এতটাই চকচকে করে ঘষামাজা করা হয়েছে যে মনে হচ্ছে ঢাকা শহর থেকে ট্রাকে করে এনেছে। দোকানদার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, "এই সাইকেল কিন্তু সাধারণ না, ভাই। এটা একবার কিনলে আর গাড়ি লাগবে না।"
হাবু মিয়া জীবনে অনেকবার ঠকেছে, কিন্তু সাইকেলের চকচকে রূপ দেখে তার বুকের ভেতর এমন টান পড়ল যে আর সামলাতে পারল না। "কত টাকা?" বলে ফেলল।
দোকানদার রহস্যময় ভঙ্গিতে গলা নামিয়ে বলল, "আপনের মতো ভালো মানুষের জন্য মাত্র আট হাজার।"
হাবু চোখ বড় বড় করে তাকাল। বাজারে সাধারণ সাইকেলের দাম চার-পাঁচ হাজার, আর এটা আট হাজার! কিন্তু দোকানদার যখন আবার বলল, "এই সাইকেলে চড়ে গেলে মানুষ আপনাকে গ্রামের এমপি মনে করবে," তখন হাবুর বুক কেঁপে উঠল। এমপি হবার শখ তার ছোটবেলা থেকে।
টাকা ধার করে, গরু বন্ধক রেখে অবশেষে হাবু মিয়া সাইকেলটা কিনে নিল।
প্রথম দিনেই সমস্যা শুরু। হাবু যখন সাইকেলে পা রাখল, তখনই সাইকেল হঠাৎ বেঁকে ডানে চলে গেল। সে যতই সোজা করার চেষ্টা করে, ততই বাঁয়ে চলে যায়। গ্রামের ছেলেপেলেরা হেসে গড়াগড়ি খায়। "হাবু ভাইয়ের সাইকেল তো মনে হয় প্রেমে পড়ছে, সে কারণে বারবার বাম দিকে ঘুরছে।"
হাবু ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরে গেল। রাতে স্ত্রী কুলসুম বলল, "এই সাইকেল তো দেখি পাগলা! কাল বাজারে গেলে পাকা রাস্তায় পড়ে মরণ হবে।" হাবু গম্ভীর গলায় বলল, "চুপ কর, তুমি বোঝ না। এই সাইকেল হচ্ছে ভিআইপি সাইকেল। আজব না হলে কি আর ভিআইপি হয়?"
পরদিন সকালে সে আবার সাইকেল নিয়ে বেরোল। এবার দেখল সাইকেল চালু হতেই প্যাডেল নিজে নিজেই ঘুরতে শুরু করেছে। হাবু তো অবাক! সে প্যাডেল ধরেও ঠিকমতো থামাতে পারে না। একবার সাইকেল এমন দ্রুত ছুটল যে গ্রামের খেজুর গাছের ফাঁক দিয়ে উড়ে যেতে যেতে তার লুঙ্গি ছিঁড়ে গেল। গ্রামের মুরুব্বিরা বলল, "আরে এ তো জ্বিনের সাইকেল!"
ধীরে ধীরে গ্রামের সবাই হাবুর এই সাইকেল নিয়ে মজা করতে শুরু করল। স্কুলের ছেলেপেলেরা বলল, "চলো, আজকে স্যার না এলে হাবু ভাইয়ের সাইকেলে চড়ে দৌড় প্রতিযোগিতা করব।" মেয়েরা টিপ্পনী কাটে, "হাবু ভাই, আপনার সাইকেল কি বিয়ের গাড়ির মতো সাজিয়ে দিব নাকি?"
হাবু এসব গায়ে মাখে না। বরং সে আরও গর্বিত বোধ করে। তার মনে হলো, "যারা হাসতেছে, তারা বুঝে না। এই সাইকেল একদিন আমাকে সোজা এমপি বানাইয়া ছাড়বে।"
একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে সাইকেল আবার আজব কাণ্ড করল। মাঝপথে হাবু দেখল রাস্তার মোড়ে তার শালা মজনু দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সাইকেল যেন নিজের ইচ্ছায় মোড় ঘুরে গিয়ে সোজা মজনুর দিকে ছুটল। মজনু ভয়ে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে গেল। হাবু হেসে বলে উঠল, "এই সাইকেলটা আমার মতোই— আত্মীয় সহ্য করতে পারে না!"
গ্রামে এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বলল সাইকেল জ্বিনে ধরা, কেউ বলল এটা নিশ্চয়ই কোনো বিদেশি আবিষ্কার। হাটে-ঘাটে আলোচনা শুরু হলো— "কিভাবে সাইকেল মানুষ চেনে?"
এক রাতে হাবু ঠিক করল, সে সাইকেলটা বেঁধে রাখবে। কিন্তু ভোরে উঠে দেখে সাইকেল নেই! সবখানে খোঁজাখুঁজি করে দেখা গেল সাইকেলটা নিজে নিজেই থানার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশও হতবাক। তারা বলল, "এ সাইকেল নিশ্চয়ই মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে চায়!"
পুলিশ হাবুকে ডেকে পাঠাল। বলল, "তুমি সাইকেলটা আমাদের দিয়ে দাও, আমরা এটাকে অফিসার বানাব।" হাবু গলা ফুলিয়ে বলল, "না, এটা আমার সাইকেল, আমি ছাড়ব না।"
পুলিশ হেসে বলে উঠল, "তাহলে ঠিক আছে, তুমি আর তোমার সাইকেল একসাথে থানায় হাজিরা দেবে।"
এরপর থেকে গ্রামে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যেত। সপ্তাহে একদিন হাবু তার পাগলা সাইকেল নিয়ে থানায় হাজিরা দিত। থানার সবাই দাঁত বের করে হাসত, কেউ কেউ ছবি তুলে ফেসবুকে দিত। ক্যাপশন দিত— "বাংলাদেশ পুলিশের নতুন বাহন।"
এদিকে হাবুর স্ত্রী কুলসুম প্রতিদিন দোয়া পড়ে সাইকেলে ফুঁ দিত। সে ভেবেছিল তাবিজ পড়ালে সাইকেল শান্ত হবে। কিন্তু শান্ত তো দূরের কথা, একদিন হাবু প্যাডেল মারতেই সাইকেল গেয়ে উঠল, "চলে আয়… চলে আয়… সোনার বাংলা!"
এমন আজব দৃশ্য দেখে গ্রামের মোল্লা মসজিদে ঘোষণা দিলেন, "সাইকেলটা আরবি শিখছে। সাবধান হও সবাই!"
শেষমেশ পরিস্থিতি এমন হলো যে হাবুর ঘরে আত্মীয়-স্বজন আসতেই ভয় পেত। কারণ সাইকেল অদ্ভুত আচরণ করত। কেউ দরজায় দাঁড়ালে সাইকেল হঠাৎ ঘণ্টি বাজিয়ে উঠত, যেন বলছে— "কে এই লোক?" কারও সাথে ঝগড়া হলে সাইকেল ঠিক তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ফলে লোকজন বলত, "হাবু ভাইয়ের সাইকেল গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে কম না।"
অবশেষে হাবু বুঝতে পারল, এ সাইকেলকে আর সামলানো যাবে না। সে একদিন চুপিসারে সাইকেলটাকে বিক্রি করতে শহরে নিয়ে গেল। ক্রেতা এসে বলল, "এটা তো একেবারে সাধারণ সাইকেল। দাম তিন হাজারের বেশি না।"
হাবুর চোখে পানি এসে গেল। আট হাজার দিয়ে কেনা সাইকেল এখন তিন হাজারেও কেউ কিনতে চাইছে না! কিন্তু ঠিক তখনই সাইকেল জোরে একটা ঘণ্টি বাজাল, তারপর হঠাৎ প্যাডেল ঘুরিয়ে ক্রেতার পায়ে ধাক্কা দিল। ক্রেতা চমকে উঠে বলল, "না না, এটা আমি নেব না।"
শেষে হতাশ হয়ে হাবু সাইকেলটাকে ফেরত নিয়ে এল গ্রামে। সে ঠিক করল, "যা হওয়ার হোক, এটা আমার জীবনসঙ্গী হয়ে গেছে। এমপি হই বা না হই, এই সাইকেলের কাহিনি একদিন ইতিহাসে লেখা থাকবে।"
সেই থেকে গ্রামের মানুষ আজও বলে— "যখন কেউ আজব কাজ করে, তখন তাকে বলা হয়— তুই তো হাবু ভাইয়ের সাইকেলের মতো!"