তৃষ্ণার্ত পৃথিবী: চারটি স্থানের গল্পে বিশ্বব্যাপী পানি সংকট

0





ভূমিকা: নীল গ্রহের কঠিন বাস্তবতা

মহাশূন্য থেকে দেখলে আমাদের গ্রহটি এক নীল মার্বেলের মতো মনে হয়। এর ৭০ শতাংশই পানি দ্বারা আবৃত। কিন্তু এই বিশাল জলরাশির মাত্র ২.৫ শতাংশ হলো স্বাদু পানি, এবং তারও একটি ক্ষুদ্র অংশই আমাদের ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য। এই সীমিত সম্পদ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে এক নীরব সংকট, যা যুদ্ধ বা মহামারীর চেয়ে কোনো অংশে কম ভয়াবহ নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অব্যবস্থাপনা—এই ত্রিমুখী আক্রমণে বিশ্বের অনেক অঞ্চল আজ তীব্র পানি সংকটের দ্বারপ্রান্তে।

এই সংকটকে কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যেতে হবে সেই সব স্থানে, যেখানে এক ফোঁটা পানির জন্য মানুষের হাহাকার শোনা যায়। এই প্রতিবেদনে আমরা কোনো সাধারণ বর্ণনা দেব না। আমরা বিশ্বজুড়ে চারটি ভিন্ন স্থানের কেস-স্টাডি তুলে ধরব, যার প্রতিটি গল্প পানি সংকটের এক একটি ভিন্ন এবং জটিল দিককে উন্মোচিত করবে।

কেস-স্টাডি ১: কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা—শহুরে সভ্যতার 'ডে জিরো' আতঙ্ক

প্রেক্ষাপট: কেপটাউন, আফ্রিকার অন্যতম সুন্দর এবং উন্নত শহর। টেবিল মাউন্টেনের পাদদেশে অবস্থিত এই শহরটি একসময় পানির প্রাচুর্যের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে, শহরটি বিশ্বের প্রথম বড় শহর হিসেবে প্রায় পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এই পরিস্থিতিকে নাম দেওয়া হয়েছিল 'ডে জিরো'—সেই দিন, যেদিন শহরের ট্যাপগুলো থেকে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে।

সংকটের কারণ:

  • তীব্র খরা: একটানা তিন বছর ধরে নজিরবিহীন খরা চলার কারণে শহরের প্রধান জলাধারগুলোর পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নেমে গিয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনকে এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত ব্যবহার: গত কয়েক দশকে শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও, পানির চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন কোনো বড় অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি। শহরের অধিবাসীরাও পানি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন।

  • ব্যবস্থাপনার অভাব: বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে আসন্ন সংকট নিয়ে সতর্ক করে আসছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়।

মোকাবিলার পদক্ষেপ এবং শিক্ষা: 'ডে জিরো'র ঘোষণাটি ছিল এক ধরনের শক থেরাপি। শহরের ৪ মিলিয়ন মানুষ এক অভূতপূর্ব সাড়া দেয়।

  • রেশনিং এবং সচেতনতা: প্রত্যেক নাগরিকের জন্য দৈনিক পানির ব্যবহার মাত্র ৫০ লিটারে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে পানি সাশ্রয়ের বিভিন্ন উপায় (যেমন: দুই মিনিটের কম সময়ে গোসল করা, টয়লেটের পানি পুনর্ব্যবহার করা) সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা হয়।

  • প্রযুক্তিগত সমাধান: কর্তৃপক্ষ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, পানি পুনর্ব্যবহার এবং লবণাক্ত পানিকে লবণমুক্ত (Desalination) করার জন্য ছোট ছোট প্ল্যান্ট স্থাপন করতে শুরু করে।

  • সামাজিক চাপ: যে পরিবারগুলো অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করত, তাদের নাম একটি পাবলিক ম্যাপে প্রকাশ করে দেওয়া হতো, যা এক ধরনের সামাজিক চাপ তৈরি করেছিল।

এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে, কেপটাউন 'ডে জিরো'কে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই ঘটনাটি বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরগুলোর জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। এটি দেখিয়েছে যে, কোনো শহরই পানি সংকটের ঊর্ধ্বে নয় এবং সংকট মোকাবিলায় নাগরিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

কেস-স্টাডি ২: আরল সাগর, মধ্য এশিয়া—একটি পরিবেশগত মহাবিপর্যয়

প্রেক্ষাপট: একসময় আরল সাগর ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ, যা কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত ছিল। এর বিশাল জলরাশির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ মৎস্য শিল্প এবং এর আশেপাশের এলাকা ছিল উর্বর। কিন্তু আজ, আরল সাগরের ৯০ শতাংশই শুকিয়ে গেছে। যেখানে একসময় নৌকা চলত, সেখানে এখন মরিচা পড়া জাহাজের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এক লবণাক্ত মরুভূমির বুকে।

সংকটের কারণ:

  • সোভিয়েত যুগের সেচ প্রকল্প: ১৯৬০-এর দশকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্য এশিয়ার শুষ্ক অঞ্চলে তুলা এবং অন্যান্য ফসল ফলানোর জন্য এক বিশাল সেচ প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের জন্য আরল সাগরের প্রধান দুটি উৎস নদী—আমূ দরিয়া এবং সির দরিয়ার গতিপথ পরিবর্তন করে হাজার হাজার মাইল খাল খনন করা হয়।

  • পানির অপচয়: সেচের জন্য খনন করা খালগুলো ছিল অত্যন্ত অদক্ষ এবং অনুন্নত, যার ফলে প্রচুর পানি বাষ্পীভূত হয়ে বা মাটিতে চুইয়ে নষ্ট হয়ে যেত।

পরিণতি: নদীগুলোর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আরল সাগরে পানির আগমন প্রায় শূন্য হয়ে যায়। অন্যদিকে, বাষ্পীভবন চলতে থাকায় এর পানির স্তর দ্রুত কমতে থাকে এবং লবণাক্ততা বাড়তে থাকে।

  • অর্থনৈতিক ধ্বংস: মৎস্য শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবিকা হারায়।

  • পরিবেশগত বিপর্যয়: সাগর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে যে লবণাক্ত এবং বিষাক্ত ধূলার মরুভূমি তৈরি হয়েছে, তা বাতাসের সাথে মিশে আশেপাশের বিশাল এলাকার কৃষি জমিকে অনুর্বর করে দিয়েছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

  • জলবায়ুর পরিবর্তন: বিশাল জলরাশি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলের স্থানীয় জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে—গ্রীষ্মকাল আরও গরম এবং শীতকাল আরও ঠান্ডা।

আরল সাগরের গল্পটি হলো প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণগুলোর একটি। এটি আমাদের শেখায় যে, স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভের জন্য পরিবেশের উপর দীর্ঘমেয়াদী আঘাত হানার পরিণতি কতটা মারাত্মক হতে পারে।

কেস-স্টাডি ৩: নীল নদ, আফ্রিকা—ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার উৎস

প্রেক্ষাপট: নীল নদ আফ্রিকার ১১টি দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং এটি মিশর ও সুদানের মতো দেশগুলোর জন্য আক্ষরিক অর্থেই লাইফলাইন। মিশর তার পানির চাহিদার ৯৭ শতাংশের জন্য নীল নদের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সম্প্রতি, ইথিওপিয়া নীল নদের উজানে 'গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম' (GERD) নামে আফ্রিকার বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে, যা এই অঞ্চলে এক তীব্র ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করেছে।

সংকটের কারণ:

  • উজানের দেশের অধিকার: ইথিওপিয়ার যুক্তি হলো, তাদের দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই বাঁধটি অপরিহার্য। তারা বলছে, নীল নদের পানির উপর তাদেরও অধিকার রয়েছে।

  • ভাটির দেশের আতঙ্ক: অন্যদিকে, মিশর এবং সুদানের আশঙ্কা হলো, এই বাঁধের কারণে তাদের দিকে নীল নদের পানিপ্রবাহ নাটকীয়ভাবে কমে যাবে, যা তাদের কৃষি, পানীয় জল এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবে। মিশর এই বিষয়টিকে তার 'অস্তিত্বের সংকট' হিসেবে দেখছে।

বর্তমান পরিস্থিতি: এই তিনটি দেশ বছরের পর বছর ধরে আলোচনা চালিয়েও বাঁধের জলাধার পূরণের গতি এবং পরিচালনার নিয়মকানুন নিয়ে কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি। ইথিওপিয়া একতরফাভাবে জলাধার পূরণ শুরু করেছে, যা মিশরকে ক্ষুব্ধ করেছে। এই সংকটটি দেখায় যে, ভবিষ্যতে পানি কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদই থাকবে না, এটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংঘাত এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের একটি প্রধান কারণ হয়ে উঠবে।

উপসংহার: সম্মিলিত দায়িত্বের বিকল্প নেই

কেপটাউনের নগর সংকট, আরল সাগরের পরিবেশগত বিপর্যয়, এবং নীল নদের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা—এই তিনটি ভিন্ন গল্প আমাদের একটি অভিন্ন সত্যের দিকেই নিয়ে যায়: পানি একটি সীমিত এবং অমূল্য সম্পদ, এবং আমরা এক বৈশ্বিক পানি সংকটের মুখোমুখি।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো একক সমাধান নেই। এর জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন (যেমন: উন্নত সেচ, পানি পুনর্ব্যবহার, ডিস্যালাইনেশন), রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। পানির প্রতিটি ফোঁটাকে মূল্যবান মনে করা এবং এর সাশ্রয়ী ব্যবহারকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে তোলা—এই সম্মিলিত দায়িত্বের কোনো বিকল্প নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!