আপনার সামনে একটি সাধারণ ডিনার প্লেট রাখা। তাতে আছে সোনালী করে ভাজা এক টুকরো মুরগির মাংস, পাশে কিছু ভাপানো সবজি আর এক টুকরো রুটি। দেখতে খুব সাধারণ, তাই না? কিন্তু যদি আমরা এই প্লেটের প্রতিটি উপাদানকে তার উৎস পর্যন্ত অনুসরণ করি, তাহলে আমরা এক অবিশ্বাস্যরকমের জটিল এবং ভঙ্গুর এক বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের সন্ধান পাব, যা জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আজ ভেঙে পড়ার মুখে।
চলুন, আজ আমরা এই সাধারণ প্লেটটিকে আমাদের মানচিত্র হিসেবে ব্যবহার করে এক বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। আমরা দেখব, আপনার এই এক বেলার খাবারটি নিশ্চিত করতে গিয়ে আমাদের এই বিশ্বকে কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে।
প্রথম যাত্রা: এক টুকরো রুটি—ইউক্রেনের উর্বর শস্যক্ষেত্র থেকে
আপনার প্লেটের ঐ নরম রুটিটি। এর গল্প শুরু হয়েছিল হাজার হাজার মাইল দূরে, ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ গমের ক্ষেতে, যা একসময় 'ইউরোপের রুটির ঝুড়ি' নামে পরিচিত ছিল।
উৎপত্তি: কৃষক মিকোলা, কিয়েভের বাইরে কোনো এক গ্রামে, তার বাপ-দাদার জমিতে সোনালী গম ফলিয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, এই গম বিক্রি করে তিনি তার মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাড় করবেন।
প্রথম বাধা—সংঘাত: কিন্তু একদিন সকালে, আকাশ থেকে বোমার শব্দে তার ঘুম ভাঙে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার শস্যক্ষেত্র হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো, যেখান থেকে এই গম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত, সেগুলো রাশিয়ার নৌবাহিনী অবরোধ করে রাখে। যে গমটুকু কোনোমতে তোলা গিয়েছিল, তা বন্দরেই আটকা পড়ে থাকে।
প্রভাব: এর ফলে, বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহ নাটকীয়ভাবে কমে যায়। যে দেশগুলো, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলো, ইউক্রেনের গমের উপর নির্ভরশীল ছিল, তারা এক ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়ে। রুটির দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। আপনার প্লেটের রুটিটি হয়তো ইউক্রেন থেকে আসেনি, হয়তো এসেছে কানাডা বা আমেরিকা থেকে। কিন্তু ইউক্রেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে, বিশ্ববাজারে গমের চাহিদা বেড়ে যায় এবং সব দেশের গমের দামই বৃদ্ধি পায়। আপনার এই এক টুকরো রুটির দামের মধ্যে লুকিয়ে আছে কৃষক মিকোলার হাহাকার এবং এক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ছায়া।
দ্বিতীয় যাত্রা: মুরগির মাংস—ব্রাজিলের সয়াবিন বন থেকে
এবার আসুন প্লেটের মুরগির টুকরোটির দিকে। এর গল্পটি আরও জটিল।
উৎপত্তি: এই মুরগিটি হয়তো আপনার স্থানীয় কোনো খামারেই বড় হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুরগিটি কী খেয়ে বড় হয়েছে? উত্তর হলো: সয়াবিন এবং ভুট্টা দিয়ে তৈরি পোল্ট্রি ফিড।
দ্বিতীয় বাধা—জলবায়ু পরিবর্তন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় সয়াবিন এবং ভুট্টা উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। গত কয়েক বছর ধরে, 'লা নিনা' নামক জলবায়ু প্যাটার্নের কারণে এই অঞ্চলে شدید খরা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির অভাবে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রভাব: উৎপাদনের ঘাটতির কারণে বিশ্ববাজারে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়ে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে আপনার স্থানীয় খামারির উপর। তাকে এখন অনেক বেশি দামে মুরগির খাবার কিনতে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নেওয়ার জন্য, তাকে মুরগির মাংসের দামও বাড়াতে হচ্ছে। সুতরাং, আপনার প্লেটের মুরগির টুকরোটির দামের সাথে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ আমেরিকার খরা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অদৃশ্য হাত।
তৃতীয় যাত্রা: ভাপানো সবজি—স্পেনের প্লাস্টিকের সমুদ্র থেকে
আপনার প্লেটের কোণায় থাকা ঐ রঙিন সবজিগুলো, ধরা যাক টমেটো আর ক্যাপসিকাম। দেখতে খুব তাজা এবং স্বাস্থ্যকর।
উৎপত্তি: এই সবজিগুলো হয়তো এসেছে স্পেনের আলমেরিয়া প্রদেশ থেকে, যা 'ইউরোপের সবজি বাগান' নামে পরিচিত। এখানকার কয়েকশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্লাস্টিকের গ্রিনহাউস তৈরি করা হয়েছে, যা মহাকাশ থেকেও দেখা যায়।
তৃতীয় বাধা—জ্বালানি সংকট: এই গ্রিনহাউসগুলোকে শীতকালে গরম রাখার জন্য এবং সেচ ব্যবস্থার জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় জ্বালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
প্রভাব: জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে, স্পেনের কৃষকদের জন্য গ্রিনহাউস চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেকে তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিতে বা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এর ফলে, ইউরোপের বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যায় এবং দাম বেড়ে যায়। যে টমেটো আপনি কিনছেন, তার দামের মধ্যে লুকিয়ে আছে ইউরোপের জ্বালানি সংকটের আঁচ।
চতুর্থ যাত্রা: সামান্য লবণ ও গোলমরিচ—মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ থেকে
সবশেষে, আপনার খাবারের উপরে ছিটিয়ে দেওয়া সামান্য লবণ আর গোলমরিচ।
উৎপত্তি: গোলমরিচ হয়তো এসেছে ভিয়েতনাম থেকে, আর লবণ হয়তো এসেছে ভারত থেকে।
চতুর্থ বাধা—সরবরাহ শৃঙ্খল সংকট (Supply Chain Crisis): কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে, বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন এক নজিরবিহীন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বন্দরগুলোতে জাহাজের জট, কন্টেইনারের অভাব এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি—এই সবকিছু মিলে পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
প্রভাব: যে গোলমরিচ বা লবণটুকু পরিবহন করতে আগে খুব সামান্য খরচ হতো, এখন তার খরচ অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত পরিবহন খরচও শেষ পর্যন্ত আপনার খাবারের প্লেটের মোট দামের সাথে যুক্ত হচ্ছে।
উপসংহার: আমাদের আন্তঃসংযুক্ত প্লেট
আপনার ডিনার প্লেটটি আর সাধারণ নেই। এটি এখন এক বিশ্বায়িত এবং ভঙ্গুর ব্যবস্থার জীবন্ত প্রমাণ। ইউক্রেনের যুদ্ধ, ব্রাজিলের খরা, ইউরোপের জ্বালানি সংকট এবং মহাসাগরের শিপিং জট—এই সবকিছুই আপনার রান্নাঘরে এসে মিলিত হয়েছে।
এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে, আমরা কতটা আন্তঃসংযুক্ত। বিশ্বের এক প্রান্তের সংকট অন্য প্রান্তের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি আমাদের আরও শেখায় যে, একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার উপর নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের হয়তো আরও স্থানীয় এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎসের দিকে ঝুঁকতে হবে, এবং আমাদের নিজেদের ভোগ-বিলাস নিয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ এই তৃষ্ণার্ত পৃথিবীতে, প্রতিটি খাবারের দানাই মূল্যবান।