ব্রিক লেনের কারি: তিন প্রজন্মের বিলেতি বাঙালির উপাখ্যান

0



প্রথম প্রজন্ম: আব্দুল মিয়ার আগমন (১৯৬৫)

আব্দুল মিয়ার কাছে লন্ডন শহরটা ছিল এক অন্তহীন কুয়াশা আর ঠান্ডার নাম। সিলেটের এক ছোট গ্রাম থেকে যখন তিনি জাহাজে করে ইস্ট ইন্ডিয়া ডকে এসে নামলেন, তখন তার সম্বল ছিল শুধু একটি টিনের স্যুটকেস আর বুকের ভেতরের এক অদম্য স্বপ্ন। তিনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন না, এখানকার সংস্কৃতি বুঝতেন না। তার প্রথম কাজ ছিল এক কাপড়ের কারখানায়, যেখানে হাড়ভাঙা খাটুনির পরও দিনের শেষে জুটত বর্ণবৈষম্যের শীতল চাহনি।

তার মতো আরও অনেক সিলেটি তরুণের ঠিকানা ছিল পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন। এই এলাকাটিই ছিল তাদের এক টুকরো দেশ। তারা একসাথে থাকতেন, একসাথে খেতেন, আর দেশের গল্প করে একে অপরের একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করতেন। আব্দুল মিয়া বুঝতে পেরেছিলেন, এই শীতল, ধূসর শহরে টিকে থাকতে হলে নিজেদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই, আরও কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে তিনি একটি ছোট ক্যাফে খুললেন। নাম দিলেন 'ঢাকা ক্যাফে'। সেখানে তারা ভাত, ডাল আর মুরগির ঝোল বিক্রি করতেন, যা মূলত ছিল নিজেদের কমিউনিটির মানুষের জন্য।

কিন্তু একদিন, একজন ইংরেজ ভদ্রলোক কৌতূহলবশত দোকানে ঢুকে তাদের খাবার খেলেন এবং মুগ্ধ হলেন। সেই দিনই আব্দুল মিয়া তার ব্যবসার ভবিষ্যৎ দেখতে পেলেন। তিনি তার মায়ের হাতের রান্নার কৌশলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করলেন 'চিকেন টিক্কা মাসালা'—একটু মিষ্টি, একটু মশলাদার, যা ব্রিটিশদের স্বাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি। এই একটি ডিশই তার ভাগ্য বদলে দিল। ধীরে ধীরে তার ছোট ক্যাফেটি একটি পুরোদস্তুর 'ইন্ডিয়ান' রেস্তোরাঁয় পরিণত হলো, যদিও এর রান্না এবং রাঁধুনি দুটোই ছিল খাঁটি সিলেটি। আব্দুল মিয়ার জীবনটা ছিল এক নিরন্তর সংগ্রাম, যার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—তার পরবর্তী প্রজন্ম যেন এই কষ্ট না পায়।

দ্বিতীয় প্রজন্ম: ফারুকের দ্বিধা (১৯৯২)

ফারুক চৌধুরী জন্মেছিলেন লন্ডনে। তার শৈশব কেটেছে ব্রিক লেনের সেই রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের সুগন্ধে। তিনি অনর্গল ককনি উচ্চারণে ইংরেজি বলতে পারতেন, স্কুলে তার বন্ধুরা ছিল ইংরেজ, জ্যামাইকান, পোলিশ। কিন্তু বাড়িতে পা রাখলেই তাকে ডুব দিতে হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে, যেখানে তার বাবা আব্দুল মিয়া সিলেটি বাংলায় কথা বলতেন এবং চাইতেন ছেলে তার ব্যবসার হাল ধরুক।

ফারুকের জন্য এই জীবনটা ছিল এক দ্বিধার জীবন। তিনি তার বাবাকে ভালোবাসতেন, তার সংগ্রামকে সম্মান করতেন। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন 'কারি শেফ' হিসেবে কল্পনা করতে পারতেন না। তার স্বপ্ন ছিল একজন আর্কিটেক্ট হওয়ার। এই নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে প্রায়ই নীরব দ্বন্দ্ব চলত। আব্দুল মিয়া বুঝতেন না, কেন তার ছেলে এই তৈরি ব্যবসা ছেড়ে অন্য কিছু করতে চায়। আর ফারুক তার বাবাকে বোঝাতে পারত না যে, সে তার নিজের একটি পরিচয় তৈরি করতে চায়, যা কেবল 'কারি হাউজের মালিকের ছেলে' হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না।

এই প্রজন্মটি ছিল এক ধরনের 'সাংস্কৃতিক দোলনায়' দুলতে থাকা প্রজন্ম। তারা পুরোপুরি ব্রিটিশও নয়, আবার পুরোপুরি বাংলাদেশিও নয়। স্কুলে তারা ছিল 'পাকিস্তানি' বা 'পাকি' (কারণ তখন ব্রিটিশরা সব দক্ষিণ এশীয়দের এক নামেই ডাকত), আর বাংলাদেশে ছুটিতে গেলে তারা ছিল 'লন্ডনি'। এই পরিচয় সংকট তাদের অনেকের জন্যই ছিল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। ফারুক শেষ পর্যন্ত তার বাবার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কিন্তু তার স্থাপত্যের স্বপ্নটা তিনি তার স্কেচবুকেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।

তৃতীয় প্রজন্ম: সামিরার সংশ্লেষণ (২০২৫)

সামিরা চৌধুরী, ফারুকের মেয়ে এবং আব্দুল মিয়ার নাতনি। সে লন্ডনের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কালচারাল স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করছে। সামিরার মধ্যে তার বাবা বা দাদার মতো কোনো পরিচয় সংকট নেই। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে একজন 'ব্রিটিশ-বাংলাদেশি' হিসেবে পরিচয় দেয়। সে একদিকে যেমন তার বন্ধুদের সাথে শেক্সপিয়ারের নাটক নিয়ে আলোচনা করে, তেমনই অন্যদিকে সে তার নানীর কাছ থেকে কাচ্চি বিরিয়ানির রেসিপি শেখে।

তার দাদা, আব্দুল মিয়া, যে রেস্তোরাঁটিকে কেবল টিকে থাকার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন, সামিরা সেটিকে দেখছে তার ঐতিহ্য এবং গর্বের উৎস হিসেবে। সে তার বাবার রেস্তোরাঁটিকে একটি নতুন রূপ দিয়েছে। নাম দিয়েছে 'ব্রিক লেন কিচেন'। এখানে এখন আর শুধু ঐতিহ্যবাহী চিকেন টিক্কা মাসালা পাওয়া যায় না, এখানে পাওয়া যায় 'পাঁচফোড়ন-ইনফিউজড সালমন' বা 'ডিকনস্ট্রাক্টেড ফুচকা'-র মতো ফিউশন ডিশ।

সামিরা একটি জনপ্রিয় ফুড ব্লগ চালায় এবং একটি ইউটিউব চ্যানেল হোস্ট করে, যেখানে সে তার দাদার সংগ্রামের গল্প এবং বাংলাদেশি খাবারের আধুনিক রূপান্তর তুলে ধরে। সে তার প্রজন্মকে শেখাচ্ছে যে, নিজেদের ঐতিহ্যকে নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, বরং একে আধুনিক বিশ্বের সাথেผสม করে এক নতুন এবং শক্তিশালী পরিচয় তৈরি করা সম্ভব।

একদিন সন্ধ্যায়, সামিরা তার বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মিয়ার পাশে বসে তার ইউটিউব চ্যানেলের একটি নতুন ভিডিও দেখাচ্ছিল। ভিডিওতে, সামিরা তার দাদাকে উৎসর্গ করে একটি নতুন ডিশ তৈরি করেছে। আব্দুল মিয়ার ঝাপসা চোখে তখন চিকচিক করছিল জল। যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি একদিন এই অচেনা শহরে পা রেখেছিলেন, তা আজ তার নাতনির হাত ধরে এক নতুন এবং সুন্দর রূপ পেয়েছে।

এই তিন প্রজন্মের গল্পটি কেবল একটি পরিবারের গল্প নয়। এটি ব্রিটেনের বুকে পুরো বাংলাদেশি ডায়াস্পোরার যাত্রার একটি প্রতিচ্ছবি—টিকে থাকার সংগ্রাম থেকে শুরু করে পরিচয় সংকট এবং সবশেষে, আত্মবিশ্বাস ও ঐতিহ্যের এক সুন্দর সংশ্লেষণ। ব্রিক লেনের কারি এখন আর শুধু একটি খাবার নয়, এটি বহু ত্যাগের, বহু স্বপ্নের এবং এক নতুন প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!