ফাস্ট ফ্যাশনের পরবর্তী শিকার: যেভাবে 'আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন' আমাদের বিবেক এবং গ্রহকে গ্রাস করছে

0


আমরা ভেবেছিলাম 'ফাস্ট ফ্যাশন' (Fast Fashion) যথেষ্ট দ্রুত ছিল। জারা (Zara) বা এইচএন্ডএম (H&M)-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো, যারা প্রতি কয়েক সপ্তাহে তাদের দোকানের ডিজাইন বদলে ফেলে, তারা আমাদের শিখিয়েছিল যে পোশাক হলো এক ধরনের ভোগ্যপণ্য—ট্রেন্ডের সাথে সাথে আসবে এবং যাবে। কিন্তু এখন, এই দ্রুতগতির জগতের চেয়েও দ্রুতগতির এক নতুন এবং আরও ভয়ংকর মডেল আবির্ভূত হয়েছে, যার নাম 'আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন'।

Shein (উচ্চারণ: শি-ইন), Temu, এবং Fashion Nova-এর মতো অনলাইন-ভিত্তিক এই ব্র্যান্ডগুলো কোনো সাপ্তাহিক বা মাসিক চক্র অনুসরণ করে না। তারা প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন ডিজাইন তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে। তাদের পোশাকের দাম এতটাই সস্তা (একটি টি-শার্ট মাত্র কয়েক ডলার) যে, তা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। এই মডেলটি টিকটক (TikTok) এবং ইনস্টাগ্রামের (Instagram) ট্রেন্ড-নির্ভর তরুণ প্রজন্মের কাছে এক নেশার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

কিন্তু এই অবিশ্বাস্যরকমের সস্তা এবং দ্রুতগতির ফ্যাশনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার বাস্তবতা—পরিবেশগত ধ্বংসযজ্ঞ, শ্রমিক শোষণ এবং এক নতুন ধরনের মানসিক সংকট, যা ফাস্ট ফ্যাশনের চেয়েও বহুগুণে মারাত্মক।

অ্যালগরিদমের রাজত্ব: যেভাবে কাজ করে আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন

আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশনের ব্যবসায়িক মডেলটি কোনো মানুষ ডিজাইন করে না, এটি ডিজাইন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI।

  • রিয়েল-টাইম ট্রেন্ড অ্যানালিসিস: Shein-এর অ্যালগরিদম প্রতিনিয়ত টিকটক, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম পর্যবেক্ষণ করে খুঁজে বের করে, কোন স্টাইল, কোন রঙ বা কোন ডিজাইনটি এই মুহূর্তে ভাইরাল হতে চলেছে।

  • তাত্ক্ষণিক উৎপাদন: কোনো একটি ট্রেন্ড শনাক্ত করার সাথে সাথেই, সেই তথ্যটি চীনে অবস্থিত তাদের হাজার হাজার ছোট ছোট কারখানার নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই কারখানাগুলো মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ডিজাইনের অল্প কিছু সংখ্যক (সাধারণত ১০০-২০০ পিস) পোশাক তৈরি করে ফেলে।

  • অন-ডিমান্ড মডেল: এই পোশাকগুলো ওয়েবসাইটে আপলোড করার পর, অ্যালগরিদম আবার পর্যবেক্ষণ করে দেখে কোন ডিজাইনটি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। যে ডিজাইনটি জনপ্রিয় হয়, কেবল সেটিরই উৎপাদন বাড়ানো হয়। আর বাকিগুলো আর তৈরি করা হয় না।

এই অবিশ্বাস্যরকমের দ্রুত এবং ডেটা-ভিত্তিক মডেলের কারণে, তারা প্রচলিত ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর চেয়ে অনেক কম সময়ে এবং অনেক কম ঝুঁকিতে নতুন নতুন ট্রেন্ড বাজারে নিয়ে আসতে পারে। যেখানে জারা একটি নতুন ডিজাইন বাজারে আনতে সময় নেয় প্রায় তিন সপ্তাহ, সেখানে Shein এই কাজটি করতে পারে মাত্র তিন দিনে।

পরিবেশগত মূল্য: একটি গ্রহের কান্না

যদি ফাস্ট ফ্যাশন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন হলো এক পরিবেশগত মহাবিপর্যয়।

  • অকল্পনীয় বর্জ্য: এই মডেলটির মূল ভিত্তিই হলো আপনাকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পোশাক কেনানো। যেহেতু পোশাকগুলোর দাম খুব কম এবং মান অত্যন্ত নিম্ন, তাই সেগুলো কয়েকবার পরার পরই ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে তৈরি হচ্ছে পোশাকের এক অকল্পনীয় পাহাড়। প্রতি বছর, এই শিল্পটি যে পরিমাণ পোশাক তৈরি করে, তার প্রায় ৮৫ শতাংশই শেষ পর্যন্ত ল্যান্ডফিল বা ময়লার ভাগাড়ে গিয়ে জমা হয়।

  • সিনথেটিক উপাদানের ব্যবহার: খরচ কমানোর জন্য, এই পোশাকগুলোর প্রায় পুরোটাই তৈরি হয় পলিয়েস্টার, নাইলন এবং অন্যান্য প্লাস্টিক-ভিত্তিক সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে। এই উপাদানগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি এবং এগুলো পচনশীল নয়। এগুলো আমাদের মাটি এবং পানিকে শত শত বছর ধরে দূষিত করতে থাকে।

  • মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ: প্রতিবার এই পোশাকগুলো ধোয়ার সময়, লক্ষ লক্ষ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা আমাদের জলপথে প্রবেশ করে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে ফিরে আসে।

মানবিক মূল্য: অদৃশ্য শ্রমিকের শোষণ

একটি ৫ ডলারের টি-শার্টের পেছনে যে মানবিক মূল্য লুকিয়ে থাকে, তা অকল্পনীয়।

  • আধুনিক দাসত্ব: এই পোশাকগুলো তৈরি হয় মূলত চীনের বিভিন্ন ছোট ছোট কারখানায়, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার বা নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই। বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই কারখানাগুলোর শ্রমিকদের দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় এবং সপ্তাহে কোনো ছুটি থাকে না। তাদের মজুরি এতটাই কম যে, তা দিয়ে একটি মানবিক জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভব।

  • স্বচ্ছতার অভাব: Shein-এর মতো কোম্পানিগুলোর সাপ্লাই চেইন অত্যন্ত অস্বচ্ছ। তারা কোন কোন কারখানায় তাদের পোশাক তৈরি করে, সেই তথ্য তারা প্রকাশ করে না। এর ফলে, তাদের কাজের পরিবেশ নিরীক্ষা করা বা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

মানসিক মূল্য: ট্রেন্ডের অন্তহীন চক্র

আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন কেবল আমাদের গ্রহ বা শ্রমিকদেরই শোষণ করে না, এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও শোষণ করে।

  • 'ট্রেন্ড' আসক্তি: টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের 'হউল' (Haul) ভিডিওগুলো (যেখানে ইনফ্লুয়েন্সাররা একসাথে অনেকগুলো নতুন পোশাক দেখায়) তরুণদের মধ্যে এক ধরনের 'ট্রেন্ড'-এর প্রতি আসক্তি তৈরি করছে। তারা মনে করছে, একই পোশাক দুইবার পরাটা লজ্জার।

  • অপ্রাপ্তি এবং অসন্তোষ: এই অন্তহীন নতুন ডিজাইনের স্রোত আমাদের মধ্যে এক ধরনের constante অপ্রাপ্তি এবং অসন্তোষ তৈরি করে। আমাদের আলমারি ভর্তি পোশাক থাকা সত্ত্বেও, আমাদের মনে হয়, "আমার পরার মতো কিছুই নেই।"

  • ঋণের বোঝা: অনেক তরুণই এই কেনাকাটার নেশা মেটাতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে।

আমরা কী করতে পারি?

এই বিশাল এবং জটিল সমস্যার বিরুদ্ধে একজন সাধারণ ভোক্তা হিসেবে আমরা হয়তো নিজেদের অসহায় মনে করতে পারি। কিন্তু সম্মিলিত পদক্ষেপই পারে পরিবর্তন আনতে।

  • কম কিনুন, ভেবে কিনুন: কেনাকাটা করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, "আমার কি এটা সত্যিই প্রয়োজন? আমি কি এটা ৩০ বারের বেশি পরব?"

  • ব্র্যান্ড নিয়ে গবেষণা করুন: কোনো ব্র্যান্ড থেকে কেনার আগে, তাদের পরিবেশগত এবং নৈতিক নীতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। Good On You-এর মতো অ্যাপ বা ওয়েবসাইট আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।

  • সেকেন্ড-হ্যান্ড বা ভিন্টেজ পোশাক কিনুন: নতুন পোশাক না কিনে, সেকেন্ড-হ্যান্ড দোকান থেকে কেনাটা পরিবেশের জন্য একটি অসাধারণ উপকারী কাজ।

  • সচেতনতা তৈরি করুন: আপনার বন্ধু এবং পরিবারের সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলুন।

ফ্যাশন হওয়া উচিত সৃজনশীলতা এবং আত্ম-প্রকাশের একটি সুন্দর মাধ্যম, শোষণ এবং ধ্বংসের একটি যন্ত্র নয়। আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশনের এই ক্ষণস্থায়ী এবং চাকচিক্যময় জগতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যটি জানার পর, সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে—আমরা কি এই ধ্বংসাত্মক চক্রের অংশ হব, নাকি একটি আরও মানবিক এবং টেকসই ফ্যাশনের পক্ষে দাঁড়াব?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!