আপনি যদি কুয়েতে বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে প্রবাসী হিসেবে কাজ করার পরিকল্পনা করেন, তাহলে একটি শব্দ আপনি ঘন ঘন শুনবেন—'কাফালা' বা স্পন্সরশিপ সিস্টেম। এই ব্যবস্থাটিই এই অঞ্চলে আপনার আইনি স্থিতি, চাকরি এবং বসবাসের ভিত্তি নির্ধারণ করে। কিন্তু কাফালা সিস্টেম আসলে কী? এটি কীভাবে কাজ করে? এবং একজন প্রবাসী কর্মী হিসেবে এই ব্যবস্থার অধীনে আপনার অধিকার ও সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী? এই পোস্টে আমরা প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলোর (FAQ) মাধ্যমে কাফালা সিস্টেমের একটি গভীর এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ তুলে ধরব।
প্রশ্ন ১: কাফালা সিস্টেম আসলে কী? উত্তর: কাফালা (الكفالة) একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ 'জামিন' বা 'পৃষ্ঠপোষকতা'। কাফালা সিস্টেম হলো একটি আইনি কাঠামো, যা মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশে অভিবাসী কর্মীদের নিয়োগ এবং তাদের বসবাসের অনুমতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো, প্রত্যেক বিদেশী কর্মীর অবশ্যই একজন স্থানীয় 'কাফিল' বা স্পন্সর থাকতে হবে। এই কাফিল হতে পারে একজন ব্যক্তি (যেমন: গৃহকর্মীর ক্ষেত্রে) অথবা একটি কোম্পানি। আপনার ভিসা, আকামা (রেসিডেন্সি পারমিট), এবং সিভিল আইডি—এই সবকিছুই আপনার কাফিলের সাথে আইনতভাবে সংযুক্ত থাকে। সহজ কথায়, আপনার কাফিলই কুয়েতে আপনার বৈধভাবে থাকা এবং কাজ করার জামিনদার।
প্রশ্ন ২: একজন নতুন প্রবাসী হিসেবে এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে? উত্তর: প্রক্রিয়াটি সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপে সম্পন্ন হয়:
চুক্তিবদ্ধ হওয়া: আপনি আপনার নিজ দেশে থাকাকালীন কুয়েতের একটি কোম্পানির (আপনার ভবিষ্যৎ কাফিল) কাছ থেকে একটি চাকরির অফার পান এবং চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
ভিসা ইস্যু: কোম্পানিটি কুয়েতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আপনার জন্য একটি 'ওয়ার্ক পারমিট' বা 'ইজনে আমাল' এবং তার উপর ভিত্তি করে একটি 'এন্ট্রি ভিসা' ইস্যু করে।
কুয়েতে আগমন: আপনি সেই ভিসা ব্যবহার করে কুয়েতে প্রবেশ করেন।
মেডিক্যাল এবং ফিঙ্গারপ্রিন্টিং: কুয়েতে পৌঁছানোর পর, আপনাকে নির্ধারিত সরকারি কেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং আঙ্গুলের ছাপ দিতে হয়।
আকামা স্ট্যাম্পিং: স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, আপনার কাফিল আপনার পাসপোর্টে 'আকামা' বা রেসিডেন্সি পারমিটের স্টিকার লাগানোর জন্য আবেদন করে। এই আকামার মেয়াদ সাধারণত এক বা দুই বছরের জন্য হয়।
সিভিল আইডি: আকামা লাগানোর পর, আপনি আপনার সিভিল আইডি কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন, যা কুয়েতে আপনার প্রধান পরিচয়পত্র।
এই পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন, আপনি আইনতভাবে আপনার কাফিলের উপর নির্ভরশীল।
প্রশ্ন ৩: কাফালা সিস্টেম নিয়ে এত সমালোচনা কেন? এর প্রধান সমস্যাগুলো কী কী? উত্তর: যদিও এই ব্যবস্থাটি নিয়োগকর্তা এবং কর্মী উভয়ের জন্যই একটি কাঠামো প্রদানের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, বাস্তবে এটি প্রায়শই কর্মীদের শোষণ এবং তাদের অধিকার হরণের একটি হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। প্রধান সমালোচনাগুলো হলো:
চাকরি পরিবর্তনে সীমাবদ্ধতা: এটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কাফালা সিস্টেমের অধীনে, আপনি আপনার কাফিলের অনুমতি বা 'রিলিজ' (স্থানীয় ভাষায় 'তানাজুল' - تنازل) ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানিতে চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন না। যদি আপনার কাফিল একজন শোষক হন বা আপনি আরও ভালো কোনো সুযোগ পান, তবুও আপনি তার অনুমতি ছাড়া চাকরি ছাড়তে পারবেন না। এটি আপনাকে একটি নির্দিষ্ট চাকরিতে আটকে রাখতে পারে এবং আপনার ক্যারিয়ারের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
শোষণের ঝুঁকি: যেহেতু আপনার আইনি স্থিতি সম্পূর্ণভাবে আপনার কাফিলের উপর নির্ভরশীল, তাই কিছু অসাধু কাফিল এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যেমন—চুক্তি অনুযায়ী বেতন না দেওয়া, অতিরিক্ত সময় কাজ করানো, বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা। কর্মী যদি এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তাহলে কাফিল তার আকামা বাতিল করে দেওয়ার বা তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে পারে।
পাসপোর্ট জব্দ করা: যদিও কুয়েতের আইন অনুযায়ী একজন কাফিলের তার কর্মীর পাসপোর্ট জব্দ করে রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ, বাস্তবে অনেক কোম্পানিই এটি করে থাকে। এর ফলে কর্মীর দেশত্যাগ করার স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং তিনি সম্পূর্ণরূপে কাফিলের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।
দেশত্যাগের অনুমতি (Exit Permit): কিছু কিছু ক্ষেত্রে, দেশ ছেড়ে (এমনকি ছুটিতেও) যাওয়ার জন্য কাফিলের কাছ থেকে একটি 'এক্সিট পারমিট'-এর প্রয়োজন হতে পারে। যদি কাফিলের সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো না থাকে, তাহলে তিনি এই অনুমতি দিতে অস্বীকার করতে পারেন।
এই সমস্যাগুলোর কারণে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রায়শই কাফালা সিস্টেমকে 'আধুনিক দাসত্বের' একটি রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
প্রশ্ন ৪: আমি কি কুয়েতে আমার স্পন্সর বা কাফিল পরিবর্তন করতে পারি? এর নিয়ম কী? উত্তর: হ্যাঁ, কাফিল পরিবর্তন করা সম্ভব, তবে এটি বেশ কিছু শর্ত এবং প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল।
ন্যূনতম সময়: সাধারণত, আপনাকে আপনার প্রথম কাফিলের অধীনে কমপক্ষে এক থেকে তিন বছর কাজ করতে হয়। এই সময়সীমাটি আপনার চুক্তির ধরণ এবং আইনের উপর নির্ভর করে।
রিলিজ বা তানাজুল: কাফিল পরিবর্তন করার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আপনার বর্তমান কাফিলের কাছ থেকে একটি 'রিলিজ লেটার' বা 'তানাজুল' নেওয়া। যদি আপনার কাফিল এতে সম্মত হন, তাহলে আপনি সহজেই নতুন কাফিলের কাছে আপনার আকামা স্থানান্তর করতে পারবেন।
রিলিজ ছাড়া স্থানান্তর: কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, আপনি কাফিলের অনুমতি ছাড়াও আকামা স্থানান্তর করার জন্য আবেদন করতে পারেন। যেমন:
যদি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়।
যদি কাফিল একটানা কয়েক মাস ধরে আপনার বেতন পরিশোধ না করে (এর জন্য উপযুক্ত প্রমাণ থাকতে হবে)।
যদি কাফিল আপনার সাথে করা চুক্তির শর্তাবলী ভঙ্গ করে। এই ক্ষেত্রে, আপনাকে শ্রম মন্ত্রণালয় বা 'শুউন'-এ (شؤون) অভিযোগ দায়ের করতে হবে এবং একটি দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে।
প্রশ্ন ৫: কাফালা সিস্টেমের অধীনে একজন কর্মী হিসেবে আমার আইনি অধিকারগুলো কী কী? উত্তর: সমালোচিত হলেও, কুয়েতের শ্রম আইন (বিশেষ করে বেসরকারি খাতের জন্য) কর্মীদের কিছু মৌলিক অধিকার প্রদান করে। আপনার এই অধিকারগুলো সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি।
লিখিত চুক্তি: আপনার কাফিল আপনাকে একটি লিখিত কাজের চুক্তি দিতে বাধ্য, যেখানে আপনার বেতন, কাজের ধরণ, কর্মঘণ্টা, এবং অন্যান্য শর্তাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা: আইন অনুযায়ী, আপনাকে দিনে ৮ ঘণ্টা বা সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। এর বেশি কাজ করলে আপনাকে ওভারটাইম ভাতা দিতে হবে।
সবেতন ছুটি: প্রতি বছর কাজের জন্য আপনি একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের সবেতন ছুটি (Annual Leave) পাওয়ার অধিকারী।
স্বাস্থ্যসেবা: আপনার কাফিল আপনার জন্য বাধ্যতামূলক সরকারি স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করতে বাধ্য।
সময়মতো বেতন: প্রতি মাসে সময়মতো আপনার বেতন পরিশোধ করা কাফিলের দায়িত্ব।
কর্ম সমাপ্তি সুবিধা (Indemnity): চাকরি শেষে, আপনি আপনার মোট কর্মকালের উপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, যা 'ইনডেমনিটি' নামে পরিচিত।
পাসপোর্ট রাখার অধিকার: আপনার পাসপোর্ট আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এটি আপনার কাছে রাখার অধিকার আপনার রয়েছে।
যদি আপনার কাফিল এই অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে, তাহলে আপনি শ্রম মন্ত্রণালয়ে ('শুউন') তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
প্রশ্ন ৬: এই কাফালা সিস্টেমের কি কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার হচ্ছে? উত্তর: হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এবং নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই কাফালা সিস্টেমে কিছু সংস্কার আনার চেষ্টা করছে। যেমন—চাকরি পরিবর্তনের নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল করা, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা, এবং অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়াকে সহজ করা। কাতার ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আগে তাদের কাফালা সিস্টেমে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। তবে, এই সংস্কারগুলোর বাস্তবায়ন এখনও অনেক ক্ষেত্রেই ধীর ও অসম্পূর্ণ।
উপসংহার: কাফালা সিস্টেম একটি জটিল এবং প্রায়শই বিতর্কিত একটি ব্যবস্থা। একজন প্রবাসী কর্মী হিসেবে, এই সিস্টেমের মধ্যে থেকেই আপনাকে নিজের অধিকার রক্ষা করে চলতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্ঞান। আপনার চুক্তিপত্রটি ভালোভাবে পড়ুন, কুয়েতের শ্রম আইন সম্পর্কে জানুন, এবং আপনার অধিকার সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকুন। মনে রাখবেন, আপনি এখানে কেবল একজন কর্মী নন, আপনি একজন মানুষ, এবং আপনার মানবিক মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে।
