চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট্ট গ্রাম— হাবলাপাড়া। গ্রামটা শান্ত, তবে বাজারে গেলে মনে হবে যুদ্ধক্ষেত্র। কারণ, এই গ্রামের মানুষদের রাগের থেকেও বেশি ওঠে পেঁয়াজের দাম।
যখনই পেঁয়াজের দাম বাড়ে, তখন বাজারে গরম হয় শুধু পেঁয়াজ নয়— কথার ঝালও।
একদিন সকালে মজিবর কাকা বাজারে গেলেন পেঁয়াজ কিনতে। স্ত্রী হালিমা বেগম সকালে কড়া নির্দেশ দিয়েছে—
“শোন, এক কেজি পেঁয়াজ না আনলে ঘরে ঢুকতে পারবি না। গতকাল মাছ ভাজতে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, পেঁয়াজের বদলে ডিম দিয়ে রান্না করতে হলো। ডিমের ঝাল হয় না, বুঝছ?”
মজিবর কাকা মাথা নিচু করে বাজারে গেলেন। বাজারে গিয়ে চোখ ছানাবড়া— পেঁয়াজের দাম ২৬০ টাকা কেজি!
তিনি দোকানদারকে বললেন,
“বাপ, একটু ছাড় দে, আমি তো গ্রাম্য লোক। অর্ধেক কেজি দিলেও চলবে।”
দোকানদার চশমা নামিয়ে তাকাল,
“বাবা, আমি ছাড় দিতে পারি, কিন্তু সরকার ছাড় দেয় না। এই পেঁয়াজ যেন প্রেমিকার মতো— দামও বেশি, তবু না কিনলে মন খারাপ।”
পাশের ক্রেতারা হাসিতে ফেটে পড়ল। মজিবর কাকা লজ্জায় লাল। কিন্তু বউয়ের ভয় আরও বড়, তাই অর্ধেক কেজি পেঁয়াজ কিনে ঘরে ফিরলেন।
ঘরে ঢুকতেই হালিমা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“অর্ধেক কেজি কেন?”
“বউ, দাম অনেক বেড়েছে।”
“দাম বেড়েছে বলেই তো আনবি! এখনই তো রান্না হবে না হলে। চল, কাল তোর জন্য আলাদা ঝাল রান্না করব— পেঁয়াজ ছাড়া।”
সেদিন রাতেই মজিবর কাকার ঘুম উধাও। পেট খিদেয় মোচড় দিচ্ছে, আর মাথায় ঘুরছে পেঁয়াজের কথা।
সকালে ঠিক করলেন, এবার কিছু একটা করতেই হবে।
তিনি গেলেন গ্রামের হাটে, পুরনো বন্ধুকে খুঁজে বের করলেন— করিমুল। করিমুল একসময় নাটক করত, এখন দালালি করে। কাকে কখন কীভাবে ঠকাতে হয়, তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
মজিবর কাকা বললেন,
“বন্ধু, পেঁয়াজের দাম কমানোর উপায় বের কর।”
করিমুল কানের পাশে হাত দিয়ে বলল,
“পেঁয়াজের দাম কমানো কঠিন, কিন্তু পেঁয়াজ বিক্রি করে বেশি টাকা কামানোর উপায় জানি।”
“তা কীভাবে?”
“একটা নতুন ব্যবসা শুরু কর— পেঁয়াজ প্রেম পরামর্শ কেন্দ্র!”
মজিবর কাকা চমকে গেলেন।
“এইটা আবার কেমন?”
করিমুল গলা পরিষ্কার করে বলল,
“দেখ, প্রেম মানে ঝাল-মিষ্টি। পেঁয়াজেও তাই আছে— কাঁদায়, আবার রান্নায় স্বাদ আনে। তাই প্রেমে কাঁদতে থাকা ছেলেদের বলবি, যদি পেঁয়াজ খাস, প্রেমের কষ্ট কমে যায়। মেয়েদের বলবি— পেঁয়াজ ছাড়া প্রেম টিকে না!”
মজিবর কাকা ভাবলেন,
“আইডিয়াটা খারাপ না।”
তারা মিলে হাটের পাশে একটা বোর্ড ঝুলিয়ে দিল—
“পেঁয়াজ প্রেম পরামর্শ কেন্দ্র – কাঁদুন, কিন্তু হাসুন!”
প্রথম দিনেই চারজন এল। একজন কলেজছাত্র বলল,
“ভাই, প্রেমিকা রাগ করে চলে গেছে।”
মজিবর কাকা একটা পেঁয়াজ এগিয়ে দিলেন,
“নাও, কেটে খাও, চোখে জল নামলে বুঝবা এখনও ভালোবাসো।”
ছেলেটা কাঁদতে লাগল। আশেপাশের লোকেরা হাসিতে মরছে।
দ্বিতীয়জন এলেন এক বউ, বললেন,
“স্বামী অন্য মেয়েকে ভালোবাসে।”
মজিবর কাকা দিলেন দুটি পেঁয়াজ, বললেন,
“একটা নিজের জন্য, একটা ওর জন্য। পরে রান্না করে খাও।”
গ্রামের সবাই পাগল হয়ে গেল। কেউ হাসছে, কেউ ভিডিও করছে। “পেঁয়াজ প্রেম পরামর্শ কেন্দ্র” রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেল।
কিন্তু বিপত্তি ঘটল যখন উপজেলা চেয়ারম্যান এলেন। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
“এটা কীসব নাটক চলছে?”
মজিবর কাকা বুক ফুলিয়ে বললেন,
“স্যার, আমরা মানুষকে কাঁদতে কাঁদতে হাসাতে চাই।”
চেয়ারম্যান হাসি চাপতে না পেরে বললেন,
“তুমি যদি এভাবে চলো, পরের নির্বাচনে ভোট না দিয়ে মানুষ তোমাকে পেঁয়াজ দেবে।”
এভাবে কয়েক সপ্তাহ কাটল। গ্রামে এখন সবাই প্রেমের কষ্ট পেলে পেঁয়াজ খায়। কেউ কাঁদে, কেউ হাসে।
হালিমা বেগমও এখন মজিবরের ব্যবসা দেখে খুশি। সে বলল,
“শোন, এখন থেকে ঝাল রান্না বাদ— তুই পেঁয়াজ বিক্রি কর, আমি প্রেম পরামর্শ দেব।”
মজিবর কাকা হেসে বললেন,
“বউ, আমরা এখন প্রেমের মন্ত্রী!”