কিন্তু একদিন, রাজ্যের এক প্রান্তে, এক পুরনো পরিত্যক্ত খনির গভীরে, আবিষ্কৃত হলো এক বিশাল নতুন সোনার ভান্ডার।
প্রথম অধ্যায়: রাজার উপহার এবং রুটির মূল্যবৃদ্ধি রাজা এই নতুন সম্পদে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি চাইলেন, এই আনন্দের ভাগ রাজ্যের প্রতিটি প্রজাকে দেবেন। তিনি ঘোষণা করলেন, এখন থেকে রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে প্রতি মাসে অতিরিক্ত দশটি করে সোনার মুদ্রা উপহার হিসেবে দেওয়া হবে।
প্রথম কয়েক সপ্তাহ, রাজ্যে যেন এক উৎসবের আমেজ। সবার হাতে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সোনার মুদ্রা। কামার, কৃষক, তাঁতি—সবাই নিজেদেরকে আগের চেয়ে অনেক বেশি ধনী মনে করতে লাগল। তারা আরও বেশি রুটি, আরও ভালো পোশাক, এবং আরও সুন্দর আসবাবপত্র কিনতে বাজারে ভিড় করতে লাগল।
কিন্তু রাজ্যের রুটিওয়ালা, হাসান, এক নতুন সমস্যায় পড়ল। তার রুটি বানানোর ক্ষমতা তো আগের মতোই। সে দিনে একশটি রুটিই বানাতে পারে। কিন্তু এখন, সেই একশটি রুটি কেনার জন্য একশ জনের বদলে পাঁচশ জন লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাদের প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে প্রচুর সোনার মুদ্রা। হাসান দেখল, তার রুটির চাহিদা তার জোগানের চেয়ে অনেক বেশি। তাই, সে একটি বুদ্ধি বের করল। সে তার রুটির দাম বাড়িয়ে দিল। যে রুটি আগে একটি সোনার মুদ্রায় পাওয়া যেত, সেটির দাম সে চাইল দুটি সোনার মুদ্রা।
মানুষ প্রথমে কিছুটা অভিযোগ করলেও, তাদের হাতে এত সোনার মুদ্রা ছিল যে, তারা সেই নতুন দামেই রুটি কিনতে শুরু করল। কামার এবং তাঁতিও দেখল, তাদের জিনিসের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। তারাও তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিল।
অর্থদেশের মানুষেরা ধনী হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি যে তাদের সোনার মুদ্রার 'ক্রয়ক্ষমতা' বা 'Purchasing Power' কমে গেছে। তাদের হাতে মুদ্রা বেড়েছে, কিন্তু সেই মুদ্রা দিয়ে তারা আগের চেয়ে বেশি জিনিস কিনতে পারছে না। রাজ্যের এই অবস্থাকেই অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় 'চাহিদা-বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি' বা 'Demand-Pull Inflation'। এটি ঘটে যখন বাজারে পণ্যের জোগানের চেয়ে মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ এবং কেনার চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ড্রাগনের আক্রমণ এবং উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি অর্থদেশের মানুষ যখন এই নতুন দামের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখনই ঘটল আরেক বিপর্যয়। রাজ্যের উত্তরে থাকা 'গমের উপত্যকা', যেখান থেকে হাসান তার রুটি বানানোর জন্য সমস্ত গম কিনত, সেখানে এক ভয়ংকর ড্রাগন আক্রমণ করল। ড্রাগনের আগুনে উপত্যকার বেশিরভাগ ফসল পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
এখন, বাজারে গমের জোগান নাটকীয়ভাবে কমে গেল। যে গমের ব্যবসায়ীরা বেঁচে গিয়েছিল, তারা তাদের অবশিষ্ট গমের দাম বাড়িয়ে দিল দশগুণ। হাসানের কাছে এখন একটি রুটি বানানোর খরচই পড়ছে দুটি সোনার মুদ্রা। সে যদি আগের দামে রুটি বিক্রি করে, তাহলে তার ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই, সে বাধ্য হয়ে তার রুটির দাম বাড়িয়ে চারটি সোনার মুদ্রা করে দিল।
এবার, মানুষের হাতে অতিরিক্ত সোনার মুদ্রা না থাকা সত্ত্বেও, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করল। কারণ, জিনিসগুলো তৈরি করার 'উপকরণ' বা 'কাঁচামাল'-এর দাম বেড়ে গেছে। এই অবস্থাকেই অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় 'ব্যয়-বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি' বা 'Cost-Push Inflation'।
তৃতীয় অধ্যায়: মজুরি-মূল্যের দুষ্টচক্র (The Wage-Price Spiral) রাজ্যের সাধারণ প্রজারা দেখল, তাদের জীবনযাত্রা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের হাতে থাকা সোনার মুদ্রা দিয়ে তারা এখন আগের অর্ধেক জিনিসও কিনতে পারছে না। তারা রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করল এবং তাদের মজুরি বাড়ানোর জন্য দাবি জানাল।
দয়ালু রাজা তাদের দাবি মেনে নিলেন এবং সবার মজুরি দ্বিগুণ করে দিলেন। কিন্তু এর ফলে, সমস্যাটি আরও জটিল হয়ে গেল। কামার যখন দেখল তাকে তার সহকারীদের দ্বিগুণ মজুরি দিতে হচ্ছে, তখন সে তার জুতোর দাম আরও বাড়িয়ে দিল। হাসান দেখল, তার কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে হচ্ছে, তাই সেও রুটির দাম আরও বাড়িয়ে দিল।
এর ফলে, মজুরি বাড়ার যে সুবিধা, তা মূল্যবৃদ্ধির কারণে আবার সারাহ হয়ে গেল। মানুষ আবার রাজার কাছে গেল মজুরি বাড়ানোর জন্য, এবং এই চক্রটি চলতেই থাকল। এটিই হলো 'মজুরি-মূল্যের দুষ্টচক্র' বা 'Wage-Price Spiral', যা মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলতে পারে।
চতুর্থ অধ্যায়: রাজকীয় ব্যাংকারের জ্ঞান (The Central Banker's Wisdom) রাজা যখন এই জটিল সমস্যা নিয়ে দিশেহারা, তখন তিনি তার সবচেয়ে জ্ঞানী পরামর্শদাতা, রাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের শরণাপন্ন হলেন। ব্যাংকার রাজাকে বোঝালেন, "মহারাজ, সমস্যাটা সোনার মুদ্রার নয়। সমস্যাটা হলো, বাজারে সোনার মুদ্রার পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে। আমাদের এখন বাজার থেকে কিছু সোনার মুদ্রা তুলে নিতে হবে, যাতে মুদ্রার মূল্য আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে।"
ব্যাংকার দুটি প্রধান পদক্ষেপ নিলেন:
১. 'রাজকীয় বন্ড' চালু: তিনি 'রাজকীয় বন্ড' নামে এক ধরনের সার্টিফিকেট চালু করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, যে নাগরিকরা তাদের অতিরিক্ত সোনার মুদ্রা এই বন্ডে জমা রাখবে, তাদের এক বছর পর ১০ শতাংশ বেশি মুদ্রা ফেরত দেওয়া হবে। এই আকর্ষণীয় প্রস্তাবের লোভে, অনেক মানুষই তাদের অতিরিক্ত মুদ্রা খরচ না করে, বন্ডে জমা রাখতে শুরু করল। এর ফলে, বাজার থেকে অর্থের প্রবাহ কমে গেল। (আধুনিক অর্থনীতিতে, এটিই হলো 'ওপেন মার্কেট অপারেশন')।
২. ঋণের উপর 'সুদ' বৃদ্ধি: ব্যাংকার রাজকীয় কোষাগার থেকে ঋণ নেওয়ার উপর 'সুদ' বা 'Interest Rate' বাড়িয়ে দিলেন। এর ফলে, ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোটা কঠিন হয়ে গেল, যা বাজারে সামগ্রিক চাহিদা কমাতে সাহায্য করল।
এই দুটি পদক্ষেপের ফলে, ধীরে ধীরে, অর্থদেশের বাজারে অর্থের প্রবাহ এবং পণ্যের জোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্য ফিরে এলো। রুটির দাম আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে এলো।
উপসংহার: মুদ্রাস্ফীতির শিক্ষা অর্থদেশের এই গল্পটি আমাদের মুদ্রাস্ফীতির মৌলিক নীতিগুলোই শেখায়। মুদ্রাস্ফীতি মানে হলো, সময়ের সাথে সাথে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। এটি হতে পারে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে, অথবা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে। আর এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রধান অস্ত্রটি থাকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে, যারা 'ইন্টারেস্ট রেট' বাড়িয়ে বা কমিয়ে বাজারে অর্থের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ভারসাম্য রক্ষা করাটাই হলো একটি সুস্থ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।