ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বে ইন্টারনেট আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে গতিময় ও সহজ। বিশেষ করে প্রবাসীদের জন্য ইন্টারনেট এক বড় আশীর্বাদ। দেশে টাকা পাঠানো, পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন তথ্য জানা বা বিনোদনের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই ডিজিটাল দুনিয়ার আলোর নিচে রয়েছে অন্ধকারের জগৎ, যা অনলাইন স্ক্যাম বা প্রতারণা নামে পরিচিত। প্রবাসীরা অনেক সময় সাইবার অপরাধীদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হন। কারণ তারা দেশে টাকা পাঠানোর জন্য অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করেন, ভিসার তথ্য খোঁজেন এবং অনেক সময় স্থানীয় আইনকানুন সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকেন না। একটি ছোট ভুল আপনার কষ্টার্জিত অর্থ বা ব্যক্তিগত তথ্য কেড়ে নিতে পারে। তাই, অনলাইন জগতে বিচরণের সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এই পোস্টে আমরা প্রবাসীদের জন্য অনলাইন প্রতারণা থেকে সুরক্ষিত থাকার ৭টি জরুরি পরামর্শ নিয়ে আলোচনা করব।
১. অপরিচিত বা সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন: এটি অনলাইন প্রতারণার সবচেয়ে সাধারণ একটি ফাঁদ। ইমেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে লোভনীয় অফার বা ভীতি প্রদর্শন করে বিভিন্ন লিংক পাঠানো হয়। যেমন—"আপনি লটারি জিতেছেন," "আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে," বা " আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির সুযোগ।" এই ধরনের লিংকে ক্লিক করলে তা আপনাকে একটি নকল ওয়েবসাইটে নিয়ে যেতে পারে (যা দেখতে অবিকল আসল ওয়েবসাইটের মতো) এবং সেখানে আপনার ইউজারনেম, পাসওয়ার্ড বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চাওয়া হতে পারে। অথবা লিংকে ক্লিক করার সাথে সাথেই আপনার ডিভাইসে ম্যালওয়্যার বা ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। করণীয়: কোনো লিংকে ক্লিক করার আগে প্রেরকের পরিচয় যাচাই করুন। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের নাম করে লিংক আসে, তবে সরাসরি তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে তথ্য যাচাই করুন। সন্দেহজনক মনে হলে লিংকটি ডিলিট করে দিন।
২. ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার আগে শতবার ভাবুন: আপনার সিভিল আইডি নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস, পাসওয়ার্ড বা পিন নম্বরের মতো সংবেদনশীল তথ্য কখনোই ফোনে, ইমেইলে বা কোনো অচেনা ওয়েবসাইটে শেয়ার করবেন না। মনে রাখবেন, কোনো বৈধ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কখনোই ইমেইল বা ফোনে আপনার পাসওয়ার্ড বা পিন জানতে চাইবে না।
৩. শক্তিশালী এবং ইউনিক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন:
সহজ পাসওয়ার্ড (যেমন: 123456, password, আপনার নাম বা জন্মতারিখ) ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার প্রতিটি অনলাইন অ্যাকাউন্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন এবং শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ডে বড় হাতের অক্ষর (Capital Letter), ছোট হাতের অক্ষর (Small Letter), সংখ্যা (Number) এবং প্রতীক (Symbol) এর মিশ্রণ থাকা উচিত। যেমন: Pr0b@$h!T!m&25। পাসওয়ার্ড মনে রাখার জন্য পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন।
৪. পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা: শপিং মল, এয়ারপোর্ট বা কফি শপের ফ্রি পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা সুবিধা জনক হলেও এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। হ্যাকাররা এসব অনিরাপদ নেটওয়ার্কে ওঁৎ পেতে থাকে এবং আপনার ডিভাইসের তথ্য চুরি করার চেষ্টা করে। পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে কখনোই অনলাইন ব্যাংকিং, আর্থিক লেনদেন বা সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদান করবেন না। একান্ত প্রয়োজনে ভিপিএন (Virtual Private Network) ব্যবহার করুন, যা আপনার ইন্টারনেট সংযোগকে এনক্রিপ্ট করে সুরক্ষা প্রদান করে।
৫. অবিশ্বাস্য অফার বা পুরস্কারের লোভ থেকে দূরে থাকুন: "আপনি আইফোন জিতেছেন" বা "মাত্র ১ ডলার দিয়ে নতুন ল্যাপটপ কিনুন"—এই ধরনের অবিশ্বাস্য অফারগুলো প্রতারণার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। যদি কোনো অফার সত্য বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, তবে সম্ভবত তা সত্য নয়। এই ধরনের বিজ্ঞাপন বা ইমেইল এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
৬. টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন: দেশে টাকা পাঠানোর সময় বিশ্বস্ত এবং বৈধ মাধ্যম ব্যবহার করুন। কোনো অপরিচিত ব্যক্তি বা এজেন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হবেন না। টাকা পাঠানোর আগে প্রাপকের অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং অন্যান্য তথ্য একাধিকবার যাচাই করে নিন। অনেক সময় প্রতারকরা আপনার বন্ধুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে বিপদের কথা বলে টাকা চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে টাকা পাঠানোর আগে সরাসরি ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নিন।
৭. টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA) চালু করুন: আপনার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাউন্টগুলোতে (যেমন: জিমেইল, ফেসবুক, অনলাইন ব্যাংকিং) টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন বা 2FA চালু করুন। এটি আপনার অ্যাকাউন্টের জন্য একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তা স্তর। 2FA চালু থাকলে, কেউ আপনার পাসওয়ার্ড জেনে গেলেও আপনার মোবাইলে আসা কোড বা বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন ছাড়া লগইন করতে পারবে না।
উপসংহার: অনলাইন জগতে সুরক্ষা সম্পূর্ণভাবে আপনার নিজের সচেতনতার উপর নির্ভরশীল। একটু সতর্কতা আপনাকে বড় ধরনের আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে। উপরের পরামর্শগুলো মেনে চললে আপনি অনেকটাই নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। আপনার কষ্টার্জিত অর্থ এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখা আপনারই দায়িত্ব। সতর্ক থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
