ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এর অগ্রযাত্রার পেছনে যে কয়েকটি খাত মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। দেশের প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কঠোর পরিশ্রম করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠান। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের ভাগ্যই পরিবর্তন করে না, বরং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে রাখে এক অনবদ্য ভূমিকা। প্রবাসীদের প্রায়শই 'রেমিট্যান্স যোদ্ধা' হিসেবে অভিহিত করা হয়, এবং এই উপাধিটি যথার্থ। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের বহুমুখী ভূমিকা এবং সম্প্রতি সরকার কর্তৃক গৃহীত নতুন নীতিমালা ও প্রণোদনা নিয়ে আলোচনা করব।
অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে রেমিট্যান্স: রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস। এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি: প্রবাসীদের পাঠানো ডলার, রিয়াল, বা ইউরো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করে। একটি স্থিতিশীল রিজার্ভ আমদানি ব্যয় মেটাতে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে এবং মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও বাংলাদেশের রিজার্ভকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে রাখতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন: রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ সরাসরি গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায়। এই অর্থ গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থান খাতে বিনিয়োগ হয়। এর ফলে গ্রামীণ এলাকায় চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
দারিদ্র্য বিমোচন: রেমিট্যান্স সরাসরি দারিদ্র্য কমাতে সাহায্য করে। অনেক পরিবার শুধুমাত্র তাদের প্রবাসী সদস্যের পাঠানো টাকার উপর নির্ভর করে দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এসেছে। এটি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবেও কাজ করে।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান: প্রবাসীরা দেশে ফিরে তাদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ছোট বা মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করছেন। এতে দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষি, মৎস্য চাষ, আবাসন এবং সেবা খাতে প্রবাসীদের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে।
সরকারের নতুন নীতিমালা ও প্রণোদনা: প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে এবং তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
২.৫% নগদ প্রণোদনা: বৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে সরকার প্রেরিত অর্থের উপর ২.৫% নগদ প্রণোদনা প্রদান করছে। এর অর্থ হলো, কেউ ১০০ টাকা পাঠালে তার প্রাপক দেশে ১০২.৫ টাকা পাচ্ছেন। এই উদ্যোগটি অবৈধ হুন্ডি ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করতে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড: সরকার সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রবাসীদের সম্মানিত করার জন্য 'রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড' প্রবর্তন করেছে। এটি প্রবাসীদের তাদের অবদানের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, যা তাদের আরও উৎসাহিত করে।
বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ: প্রবাসীরা তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় অর্জিত আয় বিভিন্ন ধরনের সরকারি বন্ডে (যেমন: ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড) বিনিয়োগ করতে পারেন। এই বন্ডগুলো আকর্ষণীয় মুনাফা প্রদান করে এবং বিনিয়োগকৃত অর্থের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
সার্বজনীন পেনশন স্কিম: সম্প্রতি চালু হওয়া সার্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রবাসীদের জন্য 'প্রবাস' নামে একটি বিশেষ স্কিম রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রবাসীরা তাদের কর্মজীবন শেষে একটি নিশ্চিত মাসিক পেনশন সুবিধার আওতায় আসতে পারবেন, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য একটি বড় আর্থিক নিরাপত্তা দেবে।
বৈধ পথে টাকা পাঠানোর গুরুত্ব: অবৈধ মাধ্যম বা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে তা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না, বরং এটি অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করে এবং দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ এবং এতে প্রেরিত অর্থ প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে, বৈধ পথে টাকা পাঠালে তা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, আপনার পরিবার প্রণোদনা সুবিধা পায় এবং আপনার লেনদেনটি সুরক্ষিত থাকে।
উপসংহার: প্রবাসীরা হলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীরব নায়ক। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে এবং লাখো পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করছে। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতিমালা প্রবাসীদের এই অবদানকে আরও সহজ ও লাভজনক করার প্রয়াস। আমাদের সকলের উচিত প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং তাদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করা। এর মাধ্যমেই গড়ে উঠবে একটি সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ।