অদৃশ্য নজরদারি: আপনি কি জানেন আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কার হাতে?

0

আপনি এই মুহূর্তে যে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, সেই স্ক্রিনের ওপার থেকে কেউ একজন নীরবে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। এটি কোনো সাই-ফাই সিনেমার প্লট নয়, এটি একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাস্তবতা। আমরা যখন ফেসবুক, গুগল, টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের মতো ফ্রি অ্যাপগুলো ব্যবহার করি, তখন আমরা ভাবি যে আমরা বিনামূল্যে একটি পরিষেবা পাচ্ছি। কিন্তু সত্যটি হলো, আমরা কোনো গ্রাহক নই; আমরাই পণ্য। আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, আমাদের গতিবিধি—এই সবকিছুই এক বিশাল ডিজিটাল বাজারে প্রতিনিয়ত বিক্রি হচ্ছে।

এই অদৃশ্য নজরদারির জাল এতটাই বিস্তৃত এবং জটিল যে আমরা এর গভীরতা কল্পনাও করতে পারি না। আপনি গতকাল রাতে গুগলে যে জুতার ছবি দেখেছিলেন, আজ সকালে ফেসবুকে ঠিক সেই জুতার বিজ্ঞাপনটি কীভাবে চলে এলো? আপনি বন্ধুর সাথে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলার পর, ইউটিউবে কেন সেই জায়গার ভিডিও সাজেশন আসছে? এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটি ডেটা মাইনিং, অ্যালগরিদম এবং টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজিংয়ের এক ভয়ংকর সমন্বয়, যার কেন্দ্রে রয়েছেন আপনি এবং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য। এই প্রতিবেদনে আমরা উন্মোচন করব কীভাবে আমাদের ডিজিটাল পদচিহ্ন প্রতিনিয়ত ট্র্যাক করা হচ্ছে এবং এই ডিজিটাল খাঁচা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়গুলো কী কী।

প্রথম অধ্যায়: কী কী তথ্য চুরি হচ্ছে?

আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনার সাধারণ জীবনযাত্রা নিয়ে কারই বা এত আগ্রহ থাকতে পারে? কিন্তু ডেটা কোম্পানিগুলোর কাছে আপনার প্রতিটি তথ্যই মূল্যবান। তারা যা কিছু সংগ্রহ করে, তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

  • ব্যক্তিগত পরিচিতি: আপনার নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেইল—এই সবকিছুই তাদের ডেটাবেসের ভিত্তি।

  • লোকেশন বা অবস্থান: আপনার স্মার্টফোনের জিপিএস-এর মাধ্যমে আপনি কখন, কোথায় যাচ্ছেন, কোন দোকানে কতক্ষণ থাকছেন, কোন রেস্তোরাঁয় খাচ্ছেন—এই সমস্ত তথ্য প্রতিনিয়ত রেকর্ড করা হচ্ছে। গুগল ম্যাপসের "টাইমলাইন" ফিচারটি খুললেই আপনি এর ভয়াবহতা দেখতে পাবেন।

  • ব্রাউজিং হিস্ট্রি: আপনি কোন ওয়েবসাইটে যাচ্ছেন, কোন জিনিস খুঁজছেন, কোন ভিডিও দেখছেন—এই সব তথ্য কুকিজ এবং ট্র্যাকিং পিক্সেলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়।

  • সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিটি: আপনি কোন পোস্টে লাইক দিচ্ছেন, কোন পেজ ফলো করছেন, কোন গ্রুপে সক্রিয় আছেন, আপনার রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শ কী—ফেসবুক এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলো আপনার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল তৈরি করার জন্য এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে।

  • যোগাযোগ: কিছু অ্যাপ আপনার কন্টাক্ট লিস্ট, এমনকি আপনার মেসেজও (মেটাডেটা) বিশ্লেষণ করার অনুমতি নিয়ে নেয়।

  • বায়োমেট্রিক ডেটা: আপনার মুখমণ্ডলের গঠন (ফেস রিকগনিশন), আপনার কণ্ঠস্বর—এইগুলোও এখন ডেটা সংগ্রহের অংশ।

এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন তথ্যকে একত্রিত করে ডেটা ব্রোকাররা আপনার একটি অত্যন্ত বিস্তারিত ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করে, যা তারা বিজ্ঞাপনদাতা, রাজনৈতিক দল, এমনকি বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছেও বিক্রি করতে পারে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: সুরক্ষার বর্ম—আপনার করণীয়

এই ডিজিটাল নজরদারি থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা হয়তো আজ আর সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু পদক্ষেপ নিলে আপনি অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে নিজের হাতে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। নিচে একটি বিস্তারিত অ্যাকশন প্ল্যান দেওয়া হলো।

অ্যাকশন প্ল্যান ১: আপনার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টকে দুর্গে পরিণত করুন

  • ফেসবুক প্রাইভেসি অডিট:

    1. Settings & Privacy > Settings > Privacy Checkup-এ যান। এখানে ফেসবুক আপনাকে ধাপে ধাপে আপনার প্রাইভেসি সেটিংস পর্যালোচনা করতে সাহায্য করবে।

    2. "Who can see what you share": আপনার পোস্ট, ফ্রেন্ড লিস্ট, এবং ব্যক্তিগত তথ্য (যেমন: জন্মতারিখ, ফোন নম্বর) কারা দেখতে পারবে, তা "Friends Only" বা "Only Me" তে সেট করুন।

    3. "How people can find you on Facebook": সার্চ ইঞ্জিন থেকে আপনার প্রোফাইলকে লিঙ্ক করার অপশনটি বন্ধ করুন। আপনার ফোন নম্বর বা ইমেইল দিয়ে আপনাকে খুঁজে পাওয়ার অপশনটিও সীমিত করুন।

    4. "Your ad preferences" > "Ad Settings": এখানে গিয়ে দেখুন কোন কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। "Categories used to reach you" এবং "Audience-based advertising" অপশনগুলো রিভিউ করুন এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যাক্সেস বন্ধ করুন।

    5. "Off-Facebook Activity": এই অপশনটি আপনাকে দেখাবে কোন কোন ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ আপনার কার্যকলাপ সম্পর্কে ফেসবুককে তথ্য পাঠাচ্ছে। এই হিস্ট্রি ক্লিয়ার করুন এবং ভবিষ্যতে ডেটা শেয়ারিং বন্ধ করার জন্য "Disconnect Future Activity" অপশনটি ব্যবহার করুন।

  • গুগল প্রাইভেসি অডিট:

    1. myaccount.google.com-এ যান এবং "Privacy & Personalization"-এ ক্লিক করুন।

    2. "Web & App Activity": এটি আপনার সার্চ, ইউটিউব হিস্ট্রি, এবং অন্যান্য গুগল পরিষেবা ব্যবহারের ডেটা সংরক্ষণ করে। আপনি এটি পজ (Pause) করে দিতে পারেন এবং পুরনো ডেটা ডিলিট করার জন্য অটো-ডিলিট (যেমন: ৩ মাস বা ১৮ মাস পর) অপশন সেট করতে পারেন।

    3. "Location History": এটি আপনার গতিবিধি ট্র্যাক করে। যদি আপনার প্রয়োজন না থাকে, তবে এটিকে সম্পূর্ণভাবে পজ করে দিন।

    4. "Ad Settings": এখানে গিয়ে "Ad Personalization" অপশনটি বন্ধ করে দিন। এটি আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখানো বন্ধ করবে না, কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের উপর ভিত্তি করে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন দেখানো বন্ধ করবে।

অ্যাকশন প্ল্যান ২: আপনার ব্রাউজারকে সুরক্ষিত রাখুন

  • ভিপিএন (VPN) ব্যবহার করুন: একটি ভালো ভিপিএন আপনার ইন্টারনেট ট্র্যাফিককে এনক্রিপ্ট করে এবং আপনার আইপি অ্যাড্রেস লুকিয়ে রাখে। এর ফলে আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP) বা পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে থাকা হ্যাকাররা আপনার কার্যকলাপ দেখতে পারে না।

  • প্রাইভেসি-ফোকাসড্ ব্রাউজার: গুগল ক্রোমের পরিবর্তে Brave বা Firefox-এর মতো ব্রাউজার ব্যবহার করুন, যেগুলোতে বিল্ট-ইন ট্র্যাকার ব্লকিং ব্যবস্থা রয়েছে।

  • সার্চ ইঞ্জিন পরিবর্তন করুন: গুগলের পরিবর্তে DuckDuckGo ব্যবহার করুন, কারণ তারা আপনার সার্চ হিস্ট্রি সংরক্ষণ করে না।

  • কুকিজ নিয়ন্ত্রণ: আপনার ব্রাউজার সেটিংসে গিয়ে থার্ড-পার্টি কুকিজ ব্লক করে দিন।

অ্যাকশন প্ল্যান ৩: স্মার্টফোন অ্যাপ পারমিশন নিরীক্ষা

একটি অ্যাপ ইন্সটল করার সময় আমরা প্রায়শই না পড়েই সব পারমিশন দিয়ে দিই। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।

  • অ্যান্ড্রয়েড: Settings > Apps > App permissions-এ যান এবং প্রতিটি অ্যাপকে কী কী পারমিশন দেওয়া হয়েছে তা রিভিউ করুন। একটি ক্যালকুলেটর অ্যাপের কেন আপনার কন্টাক্ট লিস্ট বা লোকেশন অ্যাক্সেস করার প্রয়োজন হবে? অপ্রয়োজনীয় সমস্ত পারমিশন বাতিল করুন।

  • আইফোন: Settings > Privacy & Security-তে যান। এখানে আপনি লোকেশন, মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, কন্টাক্টস ইত্যাদির অ্যাক্সেস কোন কোন অ্যাপকে দিয়েছেন, তার একটি বিস্তারিত তালিকা পাবেন। এখান থেকে অপ্রয়োজনীয় অ্যাক্সেসগুলো বন্ধ করে দিন।

উপসংহার: ডিজিটাল নাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব

ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা একটি মৌলিক অধিকার। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো আমাদের জীবনকে সহজ করার নামে এই অধিকারকে প্রতিনিয়ত ক্ষয় করে চলেছে। চূড়ান্তভাবে, আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে। প্রতিটি অ্যাপ ইন্সটল করার আগে, প্রতিটি পারমিশন দেওয়ার আগে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু শেয়ার করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন: "এই তথ্যের বিনিময়ে আমি কী পাচ্ছি এবং এর সম্ভাব্য ঝুঁকি কী?" আপনার ডেটার নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে। এটিকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বও আপনার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!