চীনের শেনঝেনের এক বিশাল, ধুলোময় কারখানার কোনো একটি অ্যাসেম্বলি লাইনে, শত শত কর্মীর হাতের স্পর্শে জন্ম নিচ্ছিল একটি ক্ষুদ্র সিলিকন চিপ। এই চিপটি হয়তো আপনার পরবর্তী স্মার্টফোন, গাড়ি বা কফি মেকারের মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কয়েক মাস পর, এই চিপটিকে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল হাজার হাজার মাইলের এক জটিল পথ—ট্রাকে করে বন্দরে, জাহাজে করে সমুদ্রে, আবার ট্রাকে করে ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে, এবং সবশেষে আপনার স্থানীয় দোকানের তাক পর্যন্ত।
কিন্তু ২০২১ সালের কোনো এক সকালে, সেই যাত্রা থেমে গেল। একটি অদৃশ্য শত্রু, কোভিড-১৯, এই সুসংগঠিত বিশ্বায়নের যন্ত্রটিকে বিকল করে দিয়েছিল। যে সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ শৃঙ্খল কয়েক দশক ধরে আমাদের সস্তা এবং সহজলভ্য পণ্যের জোগান দিয়ে আসছিল, তা এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে পড়ল। এই গল্পটি সেই ক্ষুদ্র চিপটির নয়, এই গল্পটি সেই ভেঙে পড়া শৃঙ্খলের, যার প্রতিটি ভাঙা অংশ বিশ্বের অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং আপনার আমার দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
প্রথম অধ্যায়: ভূতুড়ে বন্দরের সারি
লস অ্যাঞ্জেলেসের বন্দরের বাইরে, শান্ত প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অলসভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিল প্রায় সত্তরটি বিশালাকার কন্টেইনার জাহাজ। প্রতিটি জাহাজ প্রায় একটি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা, এবং তাদের পেটে রয়েছে হাজার হাজার কন্টেইনার, যার ভেতরে আছে খেলনা, পোশাক, গাড়ির যন্ত্রাংশ, এবং সেই শেনঝেনের ক্ষুদ্র চিপটি। তারা বন্দরে ভিড়তে পারছে না, কারণ বন্দরটি কন্টেইনারের স্তূপে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
সমস্যার শুরুটা হয়েছিল মহামারির ঠিক পরপরই। মানুষ যখন ঘরে বসে অনলাইনে কেনাকাটা শুরু করল, তখন পণ্যের চাহিদা আকস্মিকভাবে বেড়ে গেল। কিন্তু অন্যদিকে, বন্দরগুলোতে লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়মের কারণে কর্মী সংখ্যা কমে গেল। কন্টেইনার নামানোর জন্য পর্যাপ্ত ডকওয়ার্কার নেই, সেগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ট্রাক বা রেল চ্যাসি নেই, এবং সেগুলো রাখার জন্য ওয়্যারহাউসগুলোতেও আর জায়গা নেই। ফলে, যে জাহাজগুলো একসময় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খালি হয়ে যেত, সেগুলো এখন কয়েক সপ্তাহ ধরে সমুদ্রে অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অপেক্ষার প্রতিটি দিনের জন্য শিপিং কোম্পানিগুলোকে বিশাল অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে, যার খরচ শেষ পর্যন্ত যোগ হচ্ছে পণ্যের দামের সাথে।
দ্বিতীয় অধ্যায়: সোনার হরিণ—একটি খালি কন্টেইনার
আপনি হয়তো ভাবছেন, বিশ্বে তো লক্ষ লক্ষ শিপিং কন্টেইনার রয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো, কন্টেইনারগুলো ভুল জায়গায় আটকে পড়েছে। মহামারির শুরুতে, যখন চীনের কারখানাগুলো বন্ধ ছিল, তখন খালি কন্টেইনারগুলো ইউরোপ এবং আমেরিকার বন্দরগুলোতে স্তূপাকার হয়ে পড়েছিল। এরপর যখন চীনের কারখানাগুলো আবার চালু হলো এবং পণ্যের চাহিদা বাড়ল, তখন সেই খালি কন্টেইনারগুলোকে সময়মতো এশিয়ায় ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
এর ফলে তৈরি হলো এক অদ্ভুত সংকট। এশিয়ার রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে খালি কন্টেইনার খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। এর সুযোগ নিয়ে শিপিং লাইনগুলো তাদের ভাড়া বাড়িয়ে দিল আকাশছোঁয়া পর্যায়ে। যে কন্টেইনারটি মহামারির আগে এশিয়া থেকে আমেরিকায় পাঠাতে খরচ হতো প্রায় ২,০০০ ডলার, তার ভাড়া বেড়ে দাঁড়ালো ২০,০০০ ডলারে। এই অতিরিক্ত খরচ কে বহন করবে? উত্তরটি সহজ: উৎপাদক, আমদানিকারক, এবং শেষ পর্যন্ত, আপনি, অর্থাৎ ভোক্তা।
তৃতীয় অধ্যায়: জনশূন্য হাইওয়ে এবং একাকী ট্রাকচালক
ধরা যাক, আমাদের সেই চিপটিকে বহনকারী কন্টেইনারটি বহু প্রতীক্ষার পর লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দরে নামতে সক্ষম হলো। এখন তার পরবর্তী যাত্রা শুরু হওয়ার কথা একটি ট্রাকে করে কোনো এক ওয়্যারহাউসের দিকে। কিন্তু এখানেও দেখা দিল আরেক বাধা—ট্রাকচালকের অভাব।
আমেরিকা এবং ইউরোপজুড়ে কয়েক দশক ধরেই ট্রাকচালকের সংকট চলছিল। এই কাজটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য, চালকদের দিনের পর দিন পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয় এবং এর পারিশ্রমিকও তুলনামূলকভাবে কম। মহামারির সময় এই সংকট আরও তীব্র হলো। অনেক বয়স্ক চালক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে অবসর নিয়ে নিলেন, এবং নতুন চালক প্রশিক্ষণের কেন্দ্রগুলোও বন্ধ ছিল। ফলে, বন্দরে কন্টেইনারের স্তূপ জমলেও, সেগুলো দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চালক পাওয়া যাচ্ছিল না। যে কয়েকটি কোম্পানি চালক পাচ্ছিল, তারাও তাদের বেতন বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিল, যা আবারও পণ্যের পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
চতুর্থ অধ্যায়: আপনার কফি টেবিলের উপর প্রভাব
এই তিনটি আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা—বন্দরের জট, কন্টেইনারের অভাব, এবং চালকের সংকট—একসাথে মিলে তৈরি করল এক ভয়াবহ 'ডমিনো এফেক্ট', যার প্রভাব পড়ল আপনার আমার জীবনে।
পণ্যের অভাব: দোকানের তাকগুলো খালি হতে শুরু করল। নতুন গাড়ি কেনার জন্য महीनों অপেক্ষা করতে হচ্ছিল, কারণ একটি গাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় হাজার হাজার চিপের মধ্যে হয়তো একটি চিপই সেই বন্দরের জটে আটকে আছে।
মূল্যস্ফীতি: উৎপাদন এবং পরিবহনের প্রতিটি ধাপে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে সবকিছুর দাম বাড়তে শুরু করল। যেটিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন 'সাপ্লাই-সাইড ইনফ্লেশন'।
'জাস্ট-ইন-টাইম' মডেলের ব্যর্থতা: গত কয়েক দশক ধরে কোম্পানিগুলো 'জাস্ট-ইন-টাইম' নামক একটি মডেলে কাজ করত, যেখানে তারা কোনো পণ্য মজুত না রেখে, ঠিক প্রয়োজনের মুহূর্তে সরবরাহ পেত। এটি খরচ কমানোর জন্য কার্যকর হলেও, সাপ্লাই চেইনের সামান্য একটি আঘাতে এই পুরো মডেলটি ভেঙে পড়ল।
এপি লগ: নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নেওয়া
বিশ্ব এখন এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। কোম্পানিগুলো তাদের সাপ্লাই চেইনকে আরও বৈচিত্র্যময় করার কথা ভাবছে। তারা আর শুধু একটি দেশের উপর নির্ভর না করে, একাধিক দেশে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে (যাকে বলা হয় 'রিশোরিং' বা 'নিয়ারশোরিং')। বন্দরগুলোতে অটোমেশন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে, একটি বিষয় পরিষ্কার। বিশ্বায়নের সেই সোনালী যুগ, যেখানে আমরা বোতাম চাপার সাথে সাথেই পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে সস্তা পণ্য পেয়ে যেতাম, হয়তো আপাতত শেষ। সেই শেনঝেনের ক্ষুদ্র চিপটির দীর্ঘ এবং বাধাগ্রস্ত যাত্রা আমাদের শিখিয়েছে যে, আমাদের এই আপাত সংযুক্ত বিশ্বটি আসলে কতটা ভঙ্গুর। একটি টেকসই এবং স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের হয়তো আরও স্থানীয়, আরও বিকেন্দ্রীভূত এবং আরও সহনশীল একটি সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
