বাড়ি কী? চার অক্ষরের এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক মহাবিশ্বের মায়া। বাড়ি কি কেবল ইট-পাথরের একটি কাঠামো? নাকি এটি একটি ঠিকানা, যা আমাদের পাসপোর্টের পাতায় লেখা থাকে? নাকি বাড়ি একটি অনুভূতি, যা ভূগোল বা মানচিত্রের সীমানা মানে না?
একজন প্রবাসীর জন্য, এই প্রশ্নটি কোনো দার্শনিক বিলাসিতা নয়। এটি তার অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, এক নিরন্তর আর্তি।
আমার বাড়ি ছিল ইছামতী নদীর তীরে, সেই গ্রামে, যেখানে বর্ষার পানিতে উঠোন ডুবে যেত আর উঠোনের কোণায় থাকা কদম গাছটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকত। বাড়ি ছিল মায়ের হাতের রান্না করা গরম ভাতের গন্ধ, বাবার শাসন মেশানো ভালোবাসা, আর বন্ধুদের সাথে সেই ধুলোমাখা খেলার মাঠ। সেই বাড়ি ছেড়ে যখন প্রথমবার বিমানের সিঁড়িতে পা রাখি, তখন বুঝিনি, আমি কেবল একটি দেশ ছাড়ছি না, আমি আমার পরিচয়ের একটি বড় অংশকে পেছনে ফেলে আসছি।
নতুন ঠিকানা, নতুন দেয়াল মরুভূমির এই শহরে আমারও এখন একটি ঠিকানা আছে। আল জাহারার কোনো এক রাস্তার পাশে একটি বহুতল ভবনের চারতলায় আমার বাস। এই বাড়ির দেয়ালগুলো নিখুঁত, মেঝেগুলো ঝকঝকে। এসি চলে চব্বিশ ঘণ্টা, আর জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায় গোছানো রাস্তা আর সারি সারি পাম গাছ। এখানে সবকিছুই আছে—আরাম, সুবিধা, নিরাপত্তা। কিন্তু এখানে কি 'বাড়ি' আছে?
আমি এই দেয়ালগুলোকে 'বাড়ি' বানানোর অনেক চেষ্টা করেছি। দেয়ালে দেশের মানচিত্র টাঙিয়েছি, বিছানার পাশে রেখেছি পরিবারের ছবি। সপ্তাহান্তে বন্ধুদের সাথে মিলে যখন বাংলাদেশি মশলা দিয়ে রান্না করি, তখন রান্নাঘরটা ক্ষণিকের জন্য মায়ের রান্নাঘরের মতো সুগন্ধে ভরে ওঠে। আমরা যখন একসাথে বসে দেশের গল্প করি, তখন এই বসার ঘরটা এক মুহূর্তের জন্য আমাদের গ্রামের বৈঠকখানা হয়ে যায়।
কিন্তু রাত যখন গভীর হয়, বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর, এই দেয়ালগুলো আবার অচেনা হয়ে যায়। এই দেয়ালের প্রতিটি ইট জানে, আমি এখানে একজন অতিথি, একজন আগন্তুক। এই মাটি আমার নয়, এই বাতাস আমার পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস বহন করে না। এই ফ্ল্যাটের নম্বরটি আমার ঠিকানা, কিন্তু আমার পরিচয় নয়।
শিকড়ের টান, নাকি শিকড়হীনতার বিভ্রান্তি? আমরা প্রবাসীরা এক অদ্ভুত দ্বৈত জীবনযাপন করি। আমরা এখানে থাকি, কিন্তু আমাদের মন পড়ে থাকে সেখানে। আমরা বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু আমাদের স্মৃতিরা বাস করে অতীতে। আমরা ভাবি, একদিন ফিরে যাব। সেই 'ফিরে যাওয়া'র স্বপ্নই আমাদের এখানে টিকিয়ে রাখে। আমরা টাকা জমাই, দেশে জমি কিনি, বাড়ি বানাই—সেই ভবিষ্যৎ বাড়ির স্বপ্ন দেখি, যা হবে আমাদের চূড়ান্ত আশ্রয়।
কিন্তু কয়েক বছর পর, যখন সেই খুব প্রতীক্ষিত ছুটিতে দেশে ফেরা হয়, তখন এক নতুন এবং আরও জটিল সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। যে গ্রামটিকে আমি আমার হৃদয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, সেই গ্রামটি আর আগের মতো নেই। সেই ধুলোমাখা রাস্তাটা পিচঢালা হয়ে গেছে, খেলার মাঠটায় গড়ে উঠেছে নতুন দালান। আমার ছোটবেলার বন্ধুরা এখন সংসারী, তাদের জগৎটা এখন আর আমাকে কেন্দ্র করে ঘোরে না।
আমি যখন কথা বলি, আমার উচ্চারণে নাকি এখন 'বিদেশি' টান চলে এসেছে। আমার অভ্যাস, আমার চিন্তাভাবনা—অনেক কিছুই এখন তাদের কাছে অচেনা। আমি তাদের ভিড়ে থেকেও যেন একা। তারা আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি, আমি এখন তাদের কাছে একজন 'অতিথি'। নিজের বাড়িতেই আমি অতিথি। এই অনুভূতিটি, যাকে বলে 'রিভার্স কালচার শক', তা প্রবাসের একাকীত্বের চেয়েও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
তাহলে, বাড়ি কোথায়? এই অভিযাত্রার শেষে এসে আমি এক নতুন উপলব্ধি খুঁজে পেয়েছি। হয়তো, প্রবাসীর কোনো একটি নির্দিষ্ট বাড়ি থাকে না। হয়তো, বাড়ি কোনো ভৌগোলিক স্থানই নয়।
বাড়ি হলো স্মৃতির এক সংগ্রহশালা। বাড়ি হলো সেই কদম গাছের গন্ধ, যা হাজার মাইল দূর থেকেও আমার নাকে ভেসে আসে। বাড়ি হলো সেই মানুষেরা, যাদের মুখ ভিডিও কলের স্ক্রিনে দেখলে আমার বুকের ভেতরটা শান্ত হয়ে যায়। বাড়ি হলো মায়ের কণ্ঠস্বর, যা আমাকে বলে, "বাবা, ঠিকমতো খেয়েছিস তো?" বাড়ি হলো সেই অনুভূতি, যা আমি খুঁজে পাই অন্য একজন প্রবাসীর সাথে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলার সময়, যখন আমরা দুজনেই বুঝতে পারি আমাদের না বলা কষ্টগুলো। বাড়ি হলো সেই মুহূর্ত, যখন এই মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামে, আর আমার মনটা কোনো কারণ ছাড়াই আনন্দে নেচে ওঠে, কারণ বৃষ্টি আমার শেকড়ের গান গায়।
আমরা প্রবাসীরা অনেকটা সামুদ্রিক কচ্ছপের মতো। আমরা ডিম পাড়ার জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের জন্মস্থানে ফিরে যাই, কিন্তু আমাদের আসল জীবনটা কাটে এক বিশাল, উন্মুক্ত মহাসাগরে। আমাদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, পুরো বিশ্বটাই আমাদের বিচরণক্ষেত্র।
আমার পাসপোর্ট হয়তো বলবে আমার বাড়ি বাংলাদেশ। আমার সিভিল আইডি হয়তো বলবে আমার ঠিকানা কুয়েত। কিন্তু আমার হৃদয় জানে, আমার বাড়ি হলো এই দুই জগতের মাঝখানে ভেসে থাকা এক অদৃশ্য সেতু—স্মৃতি, ভালোবাসা এবং এক ধরনের মিষ্টি বেদনার সেতু। বাড়ি কী? আমি এখনও সেই উত্তরটাই খুঁজে চলেছি।