একটি দিনার এবং এক পৃথিবী: কুয়েতের পাবলিক বাসে আমার শহর দেখা

0

কুয়েতে আমার প্রবাস জীবনের প্রায় তিনটি বছর কেটে গেছে। এই সময়ে, আমার জগৎটা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত আমার বাসা, আমার অফিস, আর সপ্তাহান্তে বন্ধুদের সাথে সালমিয়ার কোনো রেস্তোরাঁ বা অ্যাভিনিউজ মলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করিডোরে। আমার যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল ট্যাক্সি অথবা বন্ধুদের গাড়ি। কুয়েতের পাবলিক বাস, যেগুলো আমি প্রতিদিন রাস্তার পাশ দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে যেতে দেখতাম, সেগুলো আমার কাছে ছিল এক অজানা জগৎ। এই লাল, সবুজ বা সাদা রঙের বাসগুলোর ভেতরে কারা যাতায়াত করে? তাদের গন্তব্য কোথায়? এই শহরের শিরা-উপশিরায় তারা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে?

এই কৌতূহল থেকেই, এক শুক্রবার সকালে আমি একটি আপাত-পাগলামি সিদ্ধান্ত নিলাম। আজ আমি কোনো ট্যাক্সি নেব না। আমি আজ এই শহরটাকে দেখব তার Public Transport System-এর চোখে। আমার পকেটে থাকবে শুধু কয়েকটি দিনার, আর হাতে থাকবে গুগল ম্যাপস। আমার মিশন: সালমিয়া থেকে শুরু করে কুয়েত সিটি, এবং সেখান থেকে আবার অন্য কোনো প্রান্তে—শুধুমাত্র বাসের উপর নির্ভর করে। এটি ছিল আমার শহরকে নতুন করে আবিষ্কার করার এক অভিযান।

প্রথম পর্ব: সকালের অনভিজ্ঞতা (সালমিয়া থেকে কুয়েত সিটি)

আমার যাত্রা শুরু হলো সালমিয়ার 'বাস স্টপ' নামক একটি প্রতীকী ছাউনির নিচ থেকে। এখানে কোনো সময়সূচী লেখা নেই, কোনো রুট ম্যাপ নেই। আছে শুধু অপেক্ষারত কিছু মুখ, যাদের চোখেমুখে এক ধরনের অভ্যস্ত ধৈর্য্য। আমি গুগল ম্যাপসে আমার গন্তব্য, কুয়েত সিটি, সেট করলাম। ম্যাপ আমাকে দেখাল, আমাকে ৯৯৯ বা ৬৬ নম্বর বাসে উঠতে হবে।

কিছুক্ষণ পরেই, একটি লাল রঙের দোতলা KPTC (Kuwait Public Transport Company) বাস এসে থামল। আমি কিছুটা দ্বিধা নিয়েই বাসে উঠলাম। বাসের কন্ডাক্টর, একজন ভারতীয় ভদ্রলোক, আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি বললাম, "কুয়েত সিটি"। তিনি একটি মেশিনে ট্যাপ করে ২৫০ ফিলস (০.২৫০ দিনার) চাইলেন। আমি একটি দিনারের নোট দিতেই, তিনি হাসিমুখে বাকি পয়সা ফেরত দিলেন। এই শহরের বুকে এত কম খরচে যাতায়াত করা যায়, এটা আমার কাছে এক নতুন আবিষ্কার ছিল।

বাসের ভেতরটা ছিল এক multicultural melting pot আমার পাশে বসেছিলেন একজন ফিলিপিনো নার্স, সামনে একজন মিশরীয় নির্মাণ শ্রমিক, আর পেছনে একদল শ্রীলঙ্কান ক্লিনার। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন, হাসছিলেন। তাদের কথোপকথনের ভাষা আমি বুঝছিলাম না, কিন্তু তাদের মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি, তাদের দৈনন্দিন জীবনের গল্পগুলো আমি যেন অনুভব করতে পারছিলাম। ট্যাক্সির কালো কাঁচের ভেতর থেকে যে শহরটাকে আমি এতদিন দেখেছি, তা ছিল এক প্রাণহীন ছবি। আজ, এই বাসের জানালা দিয়ে আমি দেখছিলাম এক জীবন্ত, কর্মচঞ্চল এবং বাস্তব কুয়েত।

দ্বিতীয় পর্ব: কুয়েত সিটির বাস টার্মিনাল—এক মহাজাগতিক জংশন

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর, বাসটি আমাকে কুয়েত সিটির প্রধান বাস টার্মিনালে নামিয়ে দিল। এটি একটি বিশাল এবং কিছুটা বিশৃঙ্খল জায়গা। এখানে শত শত বাস দাঁড়িয়ে আছে, এবং হাজার হাজার মানুষ তাদের গন্তব্যের বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। এখানে এসে প্রথমবার আমি কিছুটা দিশেহারা বোধ করলাম।

এখানেই আমি কুয়েতের বাস ব্যবস্থার মূল কাঠামোটি বুঝতে পারলাম। KPTC হলো সরকারি এবং সবচেয়ে বড় বাস কোম্পানি। তাদের বাসগুলো প্রায় সব রুটে চলে। এছাড়াও আছে CityBus (লাল রঙের) এবং KGL (সাদা রঙের) এর মতো বেসরকারি কোম্পানি, যারা নির্দিষ্ট কিছু রুটে পরিষেবা দেয়।

আমি একজন KPTC কর্মীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, বিভিন্ন এলাকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। ফারওয়ানিয়া, জিলিব, আব্বাসিয়ার মতো প্রবাসী-অধ্যুষিত এলাকাগুলোর জন্য বাস ছাড়ছে এক প্রান্ত থেকে, আবার ফাহাহিল, মাঙ্গাফের মতো দূরের এলাকাগুলোর জন্য বাস ছাড়ছে অন্য প্রান্ত থেকে। আমি একটি ছোট দোকানে গিয়ে একটি রিচার্জেবল 'বাস কার্ড' কিনে নিলাম। এটি বারবার নগদ টাকা দেওয়ার ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়।

তৃতীয় পর্ব: অজানা পথে যাত্রা (কুয়েত সিটি থেকে ফারওয়ানিয়া)

এবার আমি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই একটি বাসে উঠে পড়লাম, যার সামনে লেখা ছিল 'ফারওয়ানিয়া'। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, এই অজানা পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। এই যাত্রাটি ছিল আগেরটির চেয়ে ভিন্ন। এখানে যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিলেন দক্ষিণ এশীয়। বাসের ভেতরে চলছিল বাংলা, হিন্দি এবং মালায়ালাম ভাষার কথোপকথন।

বাসটি শহরের আধুনিক হাইওয়ে ছেড়ে, পুরনো এবং কিছুটা সংকীর্ণ রাস্তার দিকে মোড় নিল। আমি জানালার বাইরে দিয়ে দেখছিলাম এমন সব এলাকা, যা আমি আগে কখনো দেখিনি। ছোট ছোট দোকান, স্থানীয় বাজার, পুরনো বাড়িঘর। ফারওয়ানিয়ায় পৌঁছানোর পর, আমি বাস থেকে নেমে পড়লাম। এখানকার পরিবেশ সালমিয়ার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি আরও বেশি জনবহুল, আরও বেশি কোলাহলপূর্ণ, এবং আরও বেশি জীবন্ত। আমি একটি বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় ঢুকে মাত্র এক দিনার দিয়ে ভাত আর মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম। এই অভিজ্ঞতাটি আমার কাছে যেকোনো দামী রেস্তোরাঁর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান মনে হলো।

চতুর্থ পর্ব: ভ্রমণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা (ব্যবহারিক টিপস)

আমার এই সারাদিনের বাস ভ্রমণ থেকে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক শিক্ষা লাভ করেছি, যা নতুনদের জন্য সহায়ক হতে পারে:

  • গুগল ম্যাপস আপনার সেরা বন্ধু: কুয়েতের বাস রুটগুলো খুঁজে বের করার জন্য গুগল ম্যাপস অবিশ্বাস্যরকমের নির্ভুল এবং সহায়ক।

  • বাস কার্ড ব্যবহার করুন: নগদ টাকার ঝামেলা এড়াতে এবং সময় বাঁচাতে একটি রিচার্জেবল বাস কার্ড কিনে নিন।

  • সময় হাতে নিয়ে বের হন: বাসগুলো প্রায়শই ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ে, তাই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হাতে অতিরিক্ত সময় রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ।

  • বাসের নম্বরগুলো চিনুন: প্রতিটি রুটের একটি নির্দিষ্ট নম্বর থাকে। আপনার গন্তব্যের জন্য কোন কোন নম্বর বাস যায়, তা আগে থেকেই জেনে নিন।

  • ভদ্রতা বজায় রাখুন: বাসে মহিলাদের জন্য সামনের দিকে আলাদা বসার জায়গা নির্ধারিত থাকে। এই নিয়মটিকে সম্মান করুন।

শহরের হৃদয়ের স্পন্দন সন্ধ্যায়, যখন আমি আবার বাসে করে সালমিয়ায় আমার চেনা ঠিকানায় ফিরে আসছিলাম, তখন আমি আর আগের সেই মানুষটি ছিলাম না। আমি আজ এমন এক কুয়েতকে দেখেছি, যা ট্যাক্সির জানালা দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। আমি দেখেছি এই শহরের আসল চালিকাশক্তি—সেইসব সাধারণ প্রবাসী, যারা প্রতিদিন এই বাসগুলোতে চড়ে তাদের কর্মস্থলে যান, এবং নিজেদের ঘাম ও শ্রম দিয়ে এই শহরকে সচল রাখেন।

কুয়েতের পাবলিক বাস হয়তো সবচেয়ে আরামদায়ক বা দ্রুততম যাতায়াত ব্যবস্থা নয়। কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং সবচেয়ে 'খাঁটি' একটি উপায় এই শহর এবং তার মানুষদের চেনার জন্য। এই একটি দিনের অভিযান আমাকে শিখিয়েছে যে, একটি শহরকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে হলে, তার হাইওয়ে দিয়ে নয়, তার অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হয়, তার সাধারণ মানুষের সাথে চলতে হয়। আর এর জন্য, কুয়েতের পাবলিক বাসের চেয়ে ভালো কোনো বাহন আর হতে পারে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!