কুয়েতে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার নিয়ম (২০২৫): নতুনদের জন্য সম্পূর্ণ গাইড

0

 


বিশেষ প্রতিবেদন, ৩০ সেপ্টেম্বর: কুয়েতে বসবাসকারী একজন প্রবাসীর জন্য, ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকাটা কেবল একটি সুবিধা নয়, এটি অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং নতুন সম্ভাবনার চাবিকাঠি। এটি আপনাকে যেমন যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সির উপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেয়, তেমনই অনেক ভালো বেতনের চাকরির জন্যও যোগ্য করে তোলে। তবে, কুয়েতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন এবং একাধিক ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করতে হয়, যা নতুন প্রবাসীদের জন্য প্রায়শই একটি জটিল এবং বিভ্রান্তিকর গোলকধাঁধা বলে মনে হতে পারে।

এই প্রতিবেদনটি হলো সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার একটি সম্পূর্ণ মানচিত্র। এখানে আমরা কুয়েতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থেকে শুরু করে আবেদন প্রক্রিয়া, কম্পিউটার পরীক্ষা এবং চূড়ান্ত ড্রাইভিং টেস্ট—প্রতিটি বিষয় ধাপে ধাপে এবং বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যাতে আপনি এই কঠিন যাত্রার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেন।

প্রথম ধাপ: আপনি কি লাইসেন্সের জন্য যোগ্য? (Eligibility Criteria)

কুয়েতের ট্রাফিক আইন অনুযায়ী, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার আগে আপনাকে অবশ্যই কিছু কঠোর শর্ত পূরণ করতে হবে। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে, আপনার আবেদনটি শুরুতেই বাতিল হয়ে যাবে।

  • ১. আকামার ধরণ এবং মেয়াদ:

    • আপনার অবশ্যই কুয়েতের একটি বৈধ আকামা বা রেসিডেন্সি পারমিট (সাধারণত Article 18, প্রাইভেট সেক্টর ভিসা) থাকতে হবে।

    • আবেদনের সময়, আপনার আকামার মেয়াদ কমপক্ষে দুই বছর থাকতে হবে।

  • ২. ন্যূনতম মাসিক বেতন:

    • এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায়শই পরিবর্তিত একটি শর্ত। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হলে আপনার মাসিক বেতন কমপক্ষে ৬০০ কুয়েতি দিনার হতে হবে।

    • এই বেতন অবশ্যই আপনার 'ইজনে আমাল' বা ওয়ার্ক পারমিটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। বেসিক বেতন এবং অন্যান্য ভাতা মিলে এই অংকটি হতে হবে।

  • ৩. শিক্ষাগত যোগ্যতা:

    • আবেদনকারীর কমপক্ষে একটি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা ব্যাচেলর ডিগ্রি থাকতে হবে।

    • আপনার ডিগ্রির সার্টিফিকেটটি অবশ্যই আপনার নিজ দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কুয়েতে অবস্থিত আপনার দেশের দূতাবাস এবং সবশেষে কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা সত্যায়িত বা 'Attested' করা থাকতে হবে।

  • পেশাগত ব্যতিক্রম (Professional Exemptions):

    • উপরে উল্লিখিত বেতনের শর্তটি নির্দিষ্ট কিছু পেশার ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য। অর্থাৎ, এই পেশার কর্মীরা ৬০০ দিনারের কম বেতন পেলেও লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই তালিকায় সাধারণত অন্তর্ভুক্ত থাকেন:

      • ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

      • কোম্পানির ম্যানেজার (Mudeer), অ্যাকাউন্ট্যান্ট (Mohaseb)।

      • সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মী।

      • এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আরও কিছু বিশেষায়িত পেশা।

দ্বিতীয় ধাপ: কাগজের যুদ্ধ—প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সংগ্রহ

যোগ্যতা নিশ্চিত করার পর, আপনাকে একটি ফাইলের মধ্যে নিম্নলিখিত সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। প্রতিটি ডকুমেন্টের মূল কপির সাথে কমপক্ষে দুই সেট ফটোকপি সাথে রাখবেন।

  • পাসপোর্ট: মূল কপি এবং ফটোকপি (যে পাতাগুলোতে আপনার ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য এবং আকামার স্ট্যাম্প রয়েছে)।

  • সিভিল আইডি: মূল কপি এবং ফটোকপি (উভয় পাশের)।

  • আকামার কপি: পাসপোর্টে লাগানো আকামার স্টিকারের ফটোকপি।

  • ওয়ার্ক পারমিট (ইজনে আমাল): আপনার কোম্পানি থেকে নেওয়া সর্বশেষ ইজনে আমালের কপি, যেখানে আপনার বেতন এবং পেশা উল্লেখ আছে।

  • শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট: মূল সার্টিফিকেট এবং উপরে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী সম্পূর্ণ সত্যায়িত করা কপি।

  • ব্লাড গ্রুপ সার্টিফিকেট: যেকোনো স্থানীয় ক্লিনিক থেকে আপনার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করিয়ে একটি সার্টিফিকেট নিতে হবে।

  • ছবি: নির্দিষ্ট মাপের পাসপোর্ট সাইজের ছবি (সাধারণত নীল ব্যাকগ্রাউন্ড)।

  • স্পন্সরের স্বাক্ষর (Sponsor's Signature Specimen): আপনার কোম্পানির অনুমোদিত ব্যক্তির স্বাক্ষরের একটি কপি, যা 'এত্‌মাদ তোকিয়া' নামে পরিচিত।

  • ঠিকানার প্রমাণ: আপনার সিভিল আইডিতে উল্লিখিত ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে বাসার ভাড়ার চুক্তির কপি লাগতে পারে।

তৃতীয় ধাপ: ফাইল খোলা এবং কম্পিউটার পরীক্ষার তারিখ নেওয়া

সমস্ত কাগজপত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে, আপনার সিভিল আইডিতে উল্লিখিত ঠিকানা অনুযায়ী নির্ধারিত ট্র্যাফিক বিভাগে বা 'মুরূর' (مرور)-এ যেতে হবে।

  • আবেদন এবং ফাইল তৈরি: সেখানে গিয়ে একটি আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে। অনেক সময় মুরূরের আশেপাশে থাকা টাইপিং সেন্টারগুলো এই ফর্মটি পূরণ করে এবং আপনার সমস্ত কাগজপত্রের একটি ফাইল তৈরি করে দেয়।

  • ডকুমেন্ট যাচাই এবং ফি প্রদান: নির্ধারিত কাউন্টারে আপনার ফাইলটি জমা দিলে, একজন কর্মকর্তা আপনার সমস্ত ডকুমেন্ট যাচাই করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে, আপনাকে একটি নির্দিষ্ট ফি (সাধারণত ১০ দিনার) জমা দেওয়ার জন্য একটি স্লিপ দেওয়া হবে।

  • চোখের পরীক্ষা: অনেক সময় ট্র্যাফিক বিভাগের ভেতরেই চোখের ডাক্তার থাকেন, যিনি আপনার দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করবেন। অথবা, আপনাকে বাইরে থেকে চোখের পরীক্ষা করিয়ে একটি রিপোর্ট জমা দিতে হতে পারে।

  • কম্পিউটার পরীক্ষার তারিখ: সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, আপনাকে কম্পিউটার বা থিওরি পরীক্ষার জন্য একটি তারিখ এবং সময় দেওয়া হবে।

চতুর্থ ধাপ: কানুনের পরীক্ষা—কম্পিউটার বা থিওরি টেস্ট

এটি লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ার প্রথম আসল পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় কুয়েতের ট্র্যাফিক আইন, রাস্তার চিহ্ন এবং নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের নিয়মকানুন সম্পর্কে আপনার জ্ঞান যাচাই করা হয়।

  • পরীক্ষার ধরণ:

    • পরীক্ষাটি কম্পিউটারে মাল্টিপল-চয়েস প্রশ্ন (MCQ) পদ্ধতিতে নেওয়া হয়।

    • মোট ৩০টি প্রশ্ন থাকে এবং পাস করার জন্য আপনাকে কমপক্ষে ২২টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হয়।

    • আপনি আরবি বা ইংরেজি ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন।

  • কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন:

    • অফিসিয়াল হ্যান্ডবুক: ট্র্যাফিক বিভাগ থেকে একটি হ্যান্ডবুক দেওয়া হতে পারে, যেখানে সমস্ত ট্র্যাফিক সাইন এবং নিয়মকানুন চিত্রসহ বর্ণনা করা থাকে।

    • মোবাইল অ্যাপস: গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে "Kuwait Driving Test" লিখে সার্চ করলে আপনি অনেকগুলো চমৎকার অ্যাপ পাবেন। এই অ্যাপগুলোতে মক টেস্ট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে, যা আপনাকে পরীক্ষার পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করবে।

    • ইউটিউব ভিডিও: ইউটিউবেও অনেক ভিডিও রয়েছে, যেখানে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং ট্র্যাফিক সাইনগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়।

  • পরীক্ষার দিন: নির্ধারিত দিনে আপনার ফাইল এবং সিভিল আইডি সাথে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হন। পরীক্ষায় পাস করলে, আপনাকে একটি 'সফল' লেখা কাগজ দেওয়া হবে। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে আপনাকে পরবর্তী পরীক্ষার জন্য নতুন তারিখ নিতে হবে।

পঞ্চম ধাপ: চূড়ান্ত পরীক্ষা—ড্রাইভিং বা রোড টেস্ট

কম্পিউটার পরীক্ষায় পাস করার পর, আপনাকে চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে কঠিন ধাপ—ব্যবহারিক ড্রাইভিং টেস্টের জন্য একটি তারিখ দেওয়া হবে।

  • প্রশিক্ষণ (ঐচ্ছিক কিন্তু অত্যন্ত সুপারিশকৃত):

    • আপনি যদি ড্রাইভিং-এ নতুন হন বা কুয়েতের রাস্তার সাথে পরিচিত না হন, তাহলে একটি ভালো ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। প্রশিক্ষকরা আপনাকে পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কৌশল (বিশেষ করে পার্কিং) শিখিয়ে দেবেন এবং আপনাকে এখানকার ড্রাইভিং সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করাবেন।

  • পরীক্ষার ধরণ:

    • পরীক্ষাটি একজন পুলিশ কর্মকর্তার ('শোরতা') উপস্থিতিতে নেওয়া হয়।

    • আপনাকে সাধারণত কয়েকটি প্রধান কৌশল করে দেখাতে হয়:

      1. সমান্তরাল পার্কিং (Parallel Parking): দুটি গাড়ির মাঝখানে সংকীর্ণ জায়গায় গাড়ি পার্ক করা। এটিই পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

      2. ৯০-ডিগ্রি পার্কিং (90-Degree Parking): শপিং মলের মতো করে 'T' সাইন দেওয়া পার্কিং স্লটে সামনে বা পেছন থেকে গাড়ি পার্ক করা।

      3. ব্রিজ বা স্লোপ: একটি ঢালু জায়গায় গাড়ি থামিয়ে, আবার পেছনে না গড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

      4. সাধারণ ড্রাইভিং: কিছু ক্ষেত্রে, আপনাকে অল্প দূরত্বের জন্য মূল রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে দেখাতে হতে পারে, যেখানে আপনার সিগন্যাল দেওয়া, লেন পরিবর্তন করা এবং ট্র্যাফিক নিয়ম মেনে চলার দক্ষতা যাচাই করা হয়।

  • পরীক্ষার দিন: শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী থাকুন। পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন। একটি ছোট ভুলেই (যেমন: সিটবেল্ট না বাঁধা বা আয়না না দেখে লেন পরিবর্তন করা) আপনি ব্যর্থ হতে পারেন।

ষষ্ঠ ধাপ: বিজয়—লাইসেন্স হাতে পাওয়া

ড্রাইভিং টেস্টে সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, আপনাকে একটি চূড়ান্ত ফর্ম দেওয়া হবে। সেই ফর্ম এবং নির্ধারিত ফি (সাধারণত ২-৩ দিনার) জমা দেওয়ার পর, আপনার ছবি তুলে এবং বায়োমেট্রিক তথ্য নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনাকে আপনার সাধের স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডটি দিয়ে দেওয়া হবে।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি হয়তো সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা ব্যয়বহুল, কিন্তু এর চূড়ান্ত পুরস্কার—কুয়েতের রাস্তায় বৈধভাবে গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা—অমূল্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!