বর্ষাকাল। গ্রামের বাজারে ঢোকার মুখেই ঝাঁপির পর ঝাঁপি শসা সাজানো থাকে। টাটকা, সবুজ, রসে ভরা শসা দেখে কারও কারও বুক ধড়ফড় করে ওঠে। কিন্তু এ বছর শুরু হলো এক নতুন বিপদ— গ্রামের মাঠ থেকে রাতারাতি শসা গায়েব হতে লাগল।
প্রথমে ভেবেছিল গরু-ছাগল খেয়ে ফেলছে। কিন্তু ঘটনা তা না। কারণ গরু খেলে গোবর পড়ে থাকে, আর ছাগল খেলে গাছের গোড়া টুকরো হয়ে যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে— পুরো শসা গাছ কেটে নিয়ে গেছে কে যেন।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো জাবেদ আলীর। তার পাঁচ কাঠা জমির সব শসা এক রাতেই উধাও। ভোরে উঠেই চিৎকার, "হায় হায়! আমার শসা গেল রে!"
গ্রামের লোকজন ছুটে এলো। সবাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থেকে গাছের গোড়া পরীক্ষা করল। মজনু বলল, "এটা মানুষের কাজ।"
বাচ্চারা হেসে উঠল, "মানুষ কি শসা চুরি করে নাকি?"
তখন বুড়ো আব্দুল কাদের গম্ভীর গলায় বললেন, "এটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এখন শসা দিয়াই নাকি বোমা বানানো যায়!"
এই কথা শুনে গ্রামে শোরগোল। কারও মাথায় গেল না শসা দিয়ে কীভাবে বোমা হয়, কিন্তু সবাই একমত হলো— "অবশ্যই এটা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।"
পরদিন মেম্বার মাইক ভাড়া করে ঘোষণা দিলেন, "আজ রাত থেকে গ্রামে শসা পাহারা দেওয়া হবে।"
রাতে মাঠে জাবেদ, মজনু, ফজলু আর আরও পাঁচজন মিলে টর্চ হাতে বসে থাকল। মাঝরাতে হঠাৎ করেই দেখা গেল একটা কালো ছায়া গাছের দিকে এগোচ্ছে। সবাই দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল। আলো ফেলতেই দেখা গেল— ধরা পড়েছে মজনুর নিজের বউ রহিমা!
সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। জাবেদ বলল, "এই! তুই এখানে কেন?"
রহিমা হেসে বলল, "কী করব, মজনু আমাকে শসা কিনে দেয় না। তাই নিজেই মাঠ থেকে একটু আনতে এসেছিলাম।"
এ কথা শুনে সবাই হেসে খুন। মজনু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের মুরুব্বি বলল, "আচ্ছা, বউ যদি শসা চায় আর স্বামী না দেয়, তাহলে তো অপরাধ মজনুরই।"
কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ হলো না। পরদিন সকালে আবার শসা উধাও। এবার বোঝা গেল, শুধু রহিমা না, অন্য কেউও হাত মারছে।
গ্রামে গোপন তদন্ত শুরু হলো। একদল বলল, এটা নিশ্চয়ই পাশের গ্রামের কাজ। তারা ইচ্ছে করেই শসা চুরি করছে যাতে এ গ্রাম দেউলিয়া হয়ে যায়। আরেক দল বলল, শসা দিয়ে নাকি ভেষজ ওষুধ বানানো হয়, তাই ব্যবসায়ীরা গোপনে চুরি করছে।
কথা কেটে কেটে এমন পর্যায়ে গেল যে মোল্লা সাহেব ঘোষণা দিলেন, "যদি শসা চুরি বন্ধ না হয়, তবে নামাজের পর দোয়া খতম হবে।"
এদিকে বাজারে শুরু হলো গুজব। একজন বলল, "শুনছ, ঢাকা শহরে নাকি শসা কেজি দেড়শো টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাই গ্রামের শসা উধাও হচ্ছে।" অন্যজন বলল, "না ভাই, শুনছি বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। শসা নাকি এখন আমেরিকায় গহনার মতো দামি।"
এসব গুজব ছড়িয়ে গ্রামজুড়ে হুলস্থুল কাণ্ড।
একদিন গভীর রাতে আবারও পাহারা দেওয়া হচ্ছিল। হঠাৎ শব্দ হলো— "ঝুপ ঝাপ ঝুপ!" সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, একটা বস্তা ভরা শসা নিয়ে পালাচ্ছে ফজলু!
ফজলুকে পাকড়াও করা হলো। সে ভয়ে ভয়ে বলল, "আরে না না, আমি নিজের জন্য নিচ্ছিলাম না। আমি শহরে পাঠাইয়া ডলার কামাই করব।"
সবাই হেসে লুটোপুটি। "শসা দিয়ে আবার ডলার?"
ফজলু মাথা নেড়ে বলল, "আরে ভাই, বিদেশিরা নাকি শসা কেটে চোখে দিয়ে ছবি তোলে। ওই ছবি দেখে মানুষ লাইকের বন্যা দেয়। তাই ভেবেছিলাম এই শসা রফতানি করলেই ধনী হয়ে যাব।"
গ্রামের লোকজন তাকে ছেড়ে দিল, কিন্তু নাম দিল— "ডলার ফজলু"।
এদিকে সমস্যা থেকে গেল। প্রতিদিনই শসা উধাও হচ্ছে। গ্রামের মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। শেষে তারা ঠিক করল, এবার মুরুব্বিদের বদলে শিশুদের পাহারায় বসানো হবে।
রাতে শিশুরা মাঠে গান গেয়ে বসে থাকত। "শসা গেলে মানা নাই, চোর যদি ধরা যায় তাই!"
হঠাৎ একদিন দেখা গেল— পুরো মাঠে আলো ঝলমল করছে। যেন শসাগুলো নিজেরাই জ্বলছে। সবাই চিৎকার করে বলল, "আল্লাহু আকবর!"
কাছে গিয়ে দেখা গেল, আসলে টর্চ ফেলে রেখেছিল জাবেদ। কিন্তু ভয় পেয়ে অনেকেই বলল, "শসার ভেতরে জ্বিন আছে।"
শেষে একটা সত্য ঘটনা ফাঁস হলো। গ্রামের মুদি দোকানদার সালাম মিয়া স্বীকার করল, আসলে সেও রাতে শসা চুরি করত। কারণ তার দোকানে যখন লোকজন সিগারেট, বিস্কুট কিনতে আসত, তখন ফ্রি শসা দিলে ক্রেতা খুশি হতো। তাই তার বিক্রিও বাড়ত।
সবাই আবারও হেসে গড়াগড়ি। মেম্বার গম্ভীর গলায় বললেন, "এই গ্রামকে শসার থেকে রক্ষা করতে হলে নিয়ম করতে হবে— যে কেউ শসা খেতে চাইলে সরাসরি জমির মালিকের কাছে গিয়ে অনুমতি নিতে হবে।"
এরপর থেকে গ্রামে আর শসা চুরি হয়নি। তবে গ্রামের নাম হয়ে গেল— "শসা কেলেঙ্কারির গ্রাম"। বাইরের লোক এলে বলে, "এই তো সেই গ্রাম, যেখানে শসা চুরি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল!"