লোকেশন: চিয়াং মাই, থাইল্যান্ড
সকাল ৭:০০: অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙল না। ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে আর জানালার পর্দা ভেদ করে আসা সোনালী আলোয়। আমার ছোট অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে নিয়ে দেখছি, Doi Suthep পাহাড়ের চূড়াটা মেঘের চাদর সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ঢাকার সেই পরিচিত ট্র্যাফিক জ্যাম আর হর্নের শব্দের বদলে এই শান্ত, স্নিগ্ধ সকাল—এটাই তো চেয়েছিলাম। তিন বছর আগে, ঢাকার এক কর্পোরেট অফিসের কেবিন ছেড়ে যখন এই 'ডিজিটাল নোমাড' জীবন বেছে নিয়েছিলাম, তখন অনেকেই বলেছিল আমি পাগল। হয়তো আমি তাই।
সকাল ৯:০০: কাজের সময়। আমার অফিস হলো আমার কাঁধের এই ব্যাকপ্যাকটা। আজ আমার অফিস চিয়াং মাইয়ের ওল্ড সিটির ভেতরে একটি সুন্দর কো-ওয়ার্কিং স্পেস, নাম 'Punspace'। এখানে এসে ল্যাপটপটা খুলতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আমার চারপাশে জার্মানির একজন ওয়েব ডেভেলপার, ব্রাজিলের একজন ইউটিউবার, আর জাপানের একজন লেখক—সবাই নিজের জগতে মগ্ন। আমরা ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষার, কিন্তু আমাদের পরিচয় এক—আমরা ডিজিটাল নোমাড।
আমার ক্লায়েন্ট নিউইয়র্কে। তাই তার যখন রাত, আমার তখন দিন। আজকের কাজ হলো একটি টেক স্টার্টআপের জন্য কিছু ব্লগ পোস্ট লেখা। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আর কি-বোর্ডে ঝড় তুলতে তুলতে সময় কীভাবে কেটে যায়, টেরই পাই না। এখানে কোনো বস নেই যে আমার কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি মারবে, কোনো অফিসের রাজনীতি নেই। আছে শুধু ডেডলাইন আর নিজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা। এই স্বাধীনতাই এই জীবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
দুপুর ১:০০: লাঞ্চ ব্রেক। কো-ওয়ার্কিং স্পেসের পাশেই এক স্থানীয় খাবারের দোকানে গেলাম। মাত্র ৫০ বাথ (প্রায় দেড় ডলার) দিয়ে এক প্লেট অসাধারণ স্বাদের 'খাও সোই' খেলাম। এই জীবনের আরেকটি বড় সুবিধা হলো, খুব কম খরচে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং খাবারের অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। ঢাকার সেই দামী রেস্তোরাঁর চেয়ে এই রাস্তার পাশের খাবারের স্বাদ আমার কাছে হাজার গুণ বেশি খাঁটি মনে হয়।
দুপুর ২:৩০: কাজের দ্বিতীয় পর্ব। ক্লায়েন্টের সাথে একটি জুম কল ছিল। টাইম জোনের পার্থক্যটা মাঝে মাঝে বেশ ঝামেলার। আমাকে প্রায়শই গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয় মিটিংয়ের জন্য। আজ ভাগ্য ভালো, কলটা দিনের বেলাতেই পড়েছে। মিটিং শেষে ক্লায়েন্ট আমার কাজে খুব খুশি। এই মুহূর্তের কন্টেন্ট টাই এই জীবনের চালিকাশক্তি।
বিকাল ৫:০০: কাজ শেষ। এবার শহরটাকে আবিষ্কার করার পালা। একটি স্কুটার ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো, পুরনো মন্দিরগুলো দেখা, স্থানীয় মানুষের সাথে ভাঙা ভাঙা থাই ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করা—এই অভিজ্ঞতাগুলো কোনো ভ্রমণ গাইডে পাওয়া যায় না।
সন্ধ্যা ৭:০০: আজ রাতে নাইট মার্কেটে যাওয়ার পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে হবে—ভিসা। আমার ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ। কাল বা পরশুর মধ্যেই আমাকে হয়তো পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে একটি 'ভিসা রান'-এর জন্য যেতে হবে। এই জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটাই—অনিশ্চয়তা। আমি কোনো দেশের স্থায়ী বাসিন্দা নই। আমি একজন চিরস্থায়ী পর্যটক। এই দেশ থেকে ঐ দেশে ছুটে বেড়ানো, প্রতি কয়েক মাস পর পর নতুন করে ঘর গোছানো, নতুন সিম কার্ড নেওয়া—এই বিষয়গুলো মাঝে মাঝে ক্লান্তিকর মনে হয়।
রাত ৯:০০: নাইট মার্কেটে বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। এদের সাথে পরিচয় এখানেই, এই নোমাড কমিউনিটিতে। আমরা একসাথে ডিনার করলাম, নিজেদের কাজের গল্প করলাম, পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে আলোচনা করলাম। কেউ হয়তো এরপর ভিয়েতনামে যাবে, কেউ পর্তুগালে। এই ক্ষণস্থায়ী বন্ধুত্বগুলোও এই জীবনের একটি অংশ। আমরা জানি, কয়েক সপ্তাহ পর হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না, কিন্তু এই মুহূর্তগুলোই আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
রাত ১১:৩০: অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলাম। ঢাকার বাসায় মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বললাম। মা জিজ্ঞেস করলেন, "কবে ফিরবি? এভাবে আর কতদিন একা একা ঘুরবি?" আমি হাসিমুখে উত্তর দিই, "скоро আসব, মা।" কিন্তু আমি নিজেও জানি না, আমার এই 'скоরো' কবে আসবে।
ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি, আমার পরবর্তী গন্তব্যের জন্য বিমানের টিকিট সার্চ করছি। বালি? লিসবন? নাকি মেক্সিকো? সারা বিশ্বটাই যেন আমার অফিস।
এই জীবনটা বাইরে থেকে দেখতে খুব গ্ল্যামারাস মনে হয়। ইনস্টাগ্রামে বিচের ধারে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করার ছবি দেখে অনেকেই হয়তো ঈর্ষা করেন। কিন্তু এর আড়ালে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, আত্ম-শৃঙ্খলা, একাকীত্ব এবং constante অনিশ্চয়তার সাথে লড়াই। এটা কোনো ছুটি কাটানো নয়, এটা জীবনকে নিজের শর্তে বাঁচার একটি নিরন্তর প্রচেষ্টা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে, এই যাযাবর জীবনটাই আমি বেছে নিয়েছি। কারণ দিনশেষে, পাহাড়ের চূড়া ভেদ করে ওঠা ভোরের সূর্য দেখার যে আনন্দ, তা হয়তো কোনো কর্পোরেট অফিসের অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের চেয়ে আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান।