বহুদিন আগের কথা নয়। বাংলাদেশের এক সবুজ শ্যামল গ্রামে রহিম ও করিম নামে দুই বন্ধু বাস করত। দুজনেরই চোখে ছিল এক স্বপ্ন—প্রবাসে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে। একদিন সেই সুযোগ এলো। দুজনই মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে ভালো বেতনে কাজ করার সুযোগ পেল। বিমানে ওঠার সময় তারা একে অপরকে কথা দিল, "বন্ধু, দেশে যখন ফিরব, তখন রাজার মতো ফিরব।"
প্রথম অধ্যায়: স্বপ্নের দেশে প্রথম ধাপ
মরুভূমির দেশে এসে দুজনেরই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। উঁচু উঁচু বিল্ডিং, ঝাঁ-চকচকে রাস্তা আর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা। প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়ে রহিম আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে যে দামী মোবাইল ফোন, ব্র্যান্ডেড ঘড়ি আর সুন্দর পোশাকের স্বপ্ন সে দেখত, তা পূরণ করতে এক মুহূর্তও দেরি করল না। বন্ধুদের সাথে দামী রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া, দেশে পরিবারের ছোটখাটো সব আবদার মেটানো—এভাবেই তার দিন কাটতে লাগল। সে ভাবত, "আরে, টাকা তো প্রতি মাসেই আসবে। জীবনটাকে একটু উপভোগ করি।"
অন্যদিকে, করিম ছিল কিছুটা ভিন্ন। সে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে একটি ছোট ডায়েরি কিনল। সেখানে সে তার প্রতিদিনের খরচ নিখুঁতভাবে লিখে রাখতে শুরু করল। সে একটি বাজেট তৈরি করল: বেতনের ৪০% পরিবারের জন্য দেশে পাঠাবে, ৩০% নিজের থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচের জন্য রাখবে, আর বাকি ৩০% ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করবে। তার বন্ধুরা যখন নতুন গ্যাজেট নিয়ে ব্যস্ত, করিম তখন বিভিন্ন ব্যাংকের ডিপিএস (ডিপোজিট পেনশন স্কিম) এবং সঞ্চয়ী স্কিম সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে লাগল। রহিম তাকে দেখে হাসত আর বলত, "কিরে বন্ধু, এত হিসেব করে কি হবে? জীবন একটাই।" করিম মৃদু হেসে উত্তর দিত, "জীবন একটাই বলেই তো, এর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভাবতে হয়।"
দ্বিতীয় অধ্যায়: সময়ের স্রোতে সঞ্চয়ের শক্তি
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেল। রহিম আগের মতোই জীবনযাপন করছিল। তার জীবনযাত্রার মান বেড়েছিল, কিন্তু তার সঞ্চয়ের খাতা ছিল প্রায় শূন্য। প্রতি মাসে যা আয় করত, তার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যেত। দেশে টাকা পাঠাতো ঠিকই, কিন্তু সেই টাকা পরিবারের দৈনন্দিন খরচেই শেষ হয়ে যেত।
করিম কিন্তু তার পরিকল্পনা থেকে এক চুলও নড়েনি। সে তার সঞ্চয়ের টাকা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল। একটি অংশ দিয়ে সে দেশে একটি ডিপিএস চালু রেখেছিল। আরেকটি অংশ দিয়ে সে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড কিনেছিল, যা সরকার কর্তৃক প্রবাসীদের জন্য একটি নিরাপদ বিনিয়োগ। এমনকি সে শেয়ার বাজার সম্পর্কেও পড়াশোনা শুরু করেছিল এবং কিছু ভালো কোম্পানির শেয়ারে অল্প অল্প করে বিনিয়োগ করছিল।
একদিন রহিম করিমকে জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা বন্ধু, তুই এত টাকা দিয়ে কী করিস? কোনো শখ-আহ্লাদ নেই তোর?" করিম তাকে পাশে বসিয়ে বোঝাল, "দেখ রহিম, আমাদের এই প্রবাস জীবনটা চিরস্থায়ী নয়। আজ শরীরে শক্তি আছে, কাজ করছি। দশ বছর পর হয়তো এই সুযোগ থাকবে না। আমি যে টাকাটা আজ সঞ্চয় করছি, সেই টাকাটাই ভবিষ্যতে আমার জন্য কাজ করবে। একে বলে 'পাওয়ার অফ কম্পাউন্ডিং' বা চক্রবৃদ্ধি সুদ। আমার জমানো টাকা সুদ তৈরি করছে, এবং সেই সুদ আবার নতুন সুদ তৈরি করছে। এটা একটা বরফগোলার মতো, যা সময়ের সাথে সাথে গড়াতে গড়াতে অনেক বড় হয়ে যায়।"
করিম তাকে আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলল: ১. জরুরি তহবিল (Emergency Fund): "আমি এমন একটি সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা রেখেছি, যা আমি কখনোই স্পর্শ করি না। এটা আমার জরুরি তহবিল। হঠাৎ যদি আমার চাকরি চলে যায় বা দেশে কোনো বিপদ হয়, তাহলে এই টাকাটা আমাকে অন্তত ছয় মাস চলার মতো সাপোর্ট দেবে।" ২. স্বাস্থ্য বিমা (Health Insurance): "বিদেশে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমি নিজের জন্য একটি ভালো স্বাস্থ্য বিমা করে রেখেছি। এতে অসুস্থ হলে চিকিৎসার খরচ নিয়ে ভাবতে হয় না।" ৩. লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ (Goal-based Investment): "আমি দেশে একটি বাড়ি বানাতে চাই। সেই লক্ষ্যের জন্য আমি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রতি মাসে আলাদা করে বিনিয়োগ করি। লক্ষ্যটা চোখের সামনে থাকলে সঞ্চয় করার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।"
রহিম সেদিন করিমের কথাগুলো শুনল, কিন্তু পুরোপুরি আমলে নিল না। তার মনে হলো, এসব বড্ড বেশি ঝামেলার কাজ।
তৃতীয় অধ্যায়: বাস্তবতার কঠিন আঘাত
একদিন হঠাৎ করেই, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তাদের কোম্পানিতে কর্মী ছাঁটাই শুরু হলো। দুর্ভাগ্যবশত, রহিমের নাম সেই ছাঁটাইয়ের তালিকায় চলে এলো। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার হাতে যে ক'টা টাকা ছিল, তা দিয়ে এক মাসও চলার উপায় নেই। দেশে পরিবারের কাছেও হাত পাততে পারছিল না, কারণ তারা তো জানে সে বিদেশে ভালো আয় করে। চরম অসহায় অবস্থায় সে করিমের কাছে সাহায্য চাইল।
করিম কোনো দ্বিধা না করে তার জরুরি তহবিল থেকে রহিমকে ধার দিল। সে রহিমকে বলল, "বন্ধু, আজ আমি তোকে সাহায্য করতে পারছি, কারণ আমি বিপদের দিনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অর্থ উপার্জন করা যতটা জরুরি, তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করাটা তার চেয়েও বেশি জরুরি।"
এই ঘটনাটি রহিমের চোখ খুলে দিল। সে বুঝতে পারল, আর্থিক পরিকল্পনা কোনো ঝামেলা নয়, এটি প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
শেষ অধ্যায়: রাজার মতো ফেরা
আরও পাঁচ বছর পর, রহিম ও করিম দেশে ফিরে এলো। রহিম দেশে ফিরেছিল খালি হাতে, তার দশ বছরের প্রবাস জীবনের সঞ্চয় বলতে কিছুই ছিল না। তাকে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হলো।
অন্যদিকে, করিম যখন দেশে ফিরল, তখন সে সত্যিই এক রাজার মতো ফিরল। তার ডিপিএস-এর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে, যা দিয়ে সে তার স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছে। তার বন্ড এবং শেয়ার বাজারের বিনিয়োগগুলোও আকারে অনেক বড় হয়েছে। সে এখন আর্থিকভাবে এতটাই স্বচ্ছল যে, তাকে আর চাকরির জন্য চিন্তা করতে হয় না। সে তার নিজের একটি ছোট ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করল।
দুই বন্ধুর স্বপ্ন একই ছিল, কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তাদের গল্প আমাদের এটাই শেখায় যে, প্রবাস জীবনের কঠোর পরিশ্রম তখনই সার্থক হয়, যখন তার সাথে একটি সুশৃঙ্খল আর্থিক পরিকল্পনা যুক্ত থাকে। বাজেট তৈরি করা, সঞ্চয় করা, বিনিয়োগ করা এবং নিজের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করা—এইগুলোই হলো প্রবাস জীবন শেষে সত্যিকারের 'রাজার মতো' দেশে ফেরার মূল চাবিকাঠি।