থার্ড কালচার কিড: যে শিশুদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই

0


ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার, শান্ত এবং চিন্তাশীল স্বরে): প্রতিটি বিমানবন্দরে হাজারো বিদায় আর পুনর্মিলনের গল্প লেখা হয়। কিন্তু কিছু শিশুর জন্য, বিমানবন্দর কোনো গন্তব্য নয়, এটিই তাদের জীবনের সবচেয়ে পরিচিত জায়গা। তাদের পাসপোর্ট হয়তো একটি দেশের, তাদের রক্তের সম্পর্ক হয়তো অন্য দেশের, আর তাদের বেড়ে ওঠা হয়তো তৃতীয় কোনো দেশে। এদেরকে বলা হয় 'থার্ড কালচার কিড' বা তৃতীয় সংস্কৃতির শিশু (TCK)।

এরা সেইসব প্রবাসী দম্পতির সন্তান, যারা তাদের শৈশবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাদের বাবা-মায়ের দেশের বাইরে কাটিয়েছে। এরা এমন এক独特 প্রজন্মের অংশ, যাদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। তাদের কাছে "বাড়ি" কোনো স্থান নয়, "বাড়ি" হলো কিছু মানুষ আর কিছু স্মৃতি। আজ আমরা সেই থার্ড কালচার কিডদের জটিল, বর্ণময় এবং প্রায়শই ভুল বোঝা এক জগতের গভীরে প্রবেশ করব।

অ্যাক্ট ১: "তুমি কোথা থেকে এসেছ?"—সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): একজন সাধারণ মানুষের জন্য "তুমি কোথা থেকে এসেছ?"—এই প্রশ্নটির উত্তর খুব সহজ। কিন্তু একজন TCK-এর জন্য, এটি এক অস্তিত্বের সংকট। তাদের উত্তরটি কেমন হতে পারে?

অ্যানা (একটি তরুণীর কণ্ঠ, বয়স আনুমানিক ২২, কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের সাথে দ্বিধার মিশ্রণ): (হেসে) এই প্রশ্নটা শুনলেই আমি ঘাবড়ে যাই। আমি কী বলব? আমি জন্মেছি লন্ডনে, আমার বাবা-মা বাংলাদেশি, কিন্তু আমার জীবনের প্রথম ১৮ বছরের ১৬ বছরই কেটেছে দুবাইতে। আমি অনর্গল আরবি বলতে পারি, কিন্তু আমার বাংলা উচ্চারণে কিছুটা টান আছে। আমি যখন বাংলাদেশে ছুটিতে যাই, আমার কাজিনরা আমাকে 'দুবাই-ফেরত' বলে ডাকে, আমি নাকি তাদের মতো 'খাঁটি' বাংলাদেশি নই। আবার দুবাইতে, আমার এমিরিতি বন্ধুদের কাছে আমি সবসময়ই একজন 'বিদেশি'। লন্ডনে গেলে তো কথাই নেই, সেখানে আমি শুধুই একজন 'ব্রাউন গার্ল'। তাহলে, আমি আসলে কোথা থেকে এসেছি? আমার শেকড়টা কোথায়? সত্যি বলতে, আমি জানি না।

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): অ্যানার এই অনুভূতিটি প্রায় সব TCK-এর। তারা একই সাথে অনেক সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু কোনো একটি সংস্কৃতির সাথেই পুরোপুরি একাত্ম হতে পারে না। তারা অনেকটা সাংস্কৃতিক গিরগিটির মতো, যেকোনো পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু তাদের আসল রঙটা কী, তা তারা নিজেরাই হয়তো জানে না। এই অনুভূতিটি তাদের মধ্যে এক ধরনের 'সাংস্কৃতিক গৃহহীনতা' বা 'Cultural Homelessness' তৈরি করে।

অ্যাক্ট ২: বিশ্বের জানালা—এক অসাধারণ উপহার

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): তবে এই শেকড়হীনতার অনুভূতির সাথেই আসে এক অসাধারণ উপহার—এক বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি। TCK-রা শিশুকাল থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মের মানুষের সাথে মিশে বড় হয়।

সামির (একজন যুবকের কণ্ঠ, বয়স আনুমানিক ২৫, কণ্ঠে উচ্ছ্বাস): আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল একজন ফিলিপিনো, আমি ফুটবল খেলতাম এক আইরিশ বন্ধুর সাথে, আর আমার প্রথম ক্রাশ ছিল এক লেবানিজ মেয়ে। আমার কাছে, ভিন্ন সংস্কৃতি বা ভিন্ন গায়ের রঙ কখনোই কোনো আলোচনার বিষয় ছিল না, এটা ছিল আমার জীবনের স্বাভাবিকতা। আমি তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারি, এবং আমি খুব সহজেই বুঝতে পারি যে, একটি সমস্যার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। আমার মনে হয়, এই অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক বেশি সহনশীল এবং খোলা মনের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। কর্পোরেট জগতে, এই 'সাংস্কৃতিক বুদ্ধিমত্তা' বা 'Cultural Intelligence' আমাকে আমার সহকর্মীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রাখে।

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): সামিরের কথাই ঠিক। গবেষণায় দেখা গেছে, TCK-রা প্রায়শই প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনীতি, এবং বহু-সাংস্কৃতিক পরিবেশে কাজ করার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য লাভ করে। তাদের কাছে, পুরো বিশ্বটাই তাদের খেলার মাঠ।

অ্যাক্ট ৩: বিদায়ের বেদনা—এক চিরস্থায়ী সঙ্গী

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): কিন্তু এই বিশ্বজনীন জীবনের একটি painful দিকও রয়েছে। তা হলো, বিদায়। প্রবাসীদের জীবন চিরস্থায়ী নয়। বাবার চাকরির চুক্তি শেষ, অথবা নতুন কোনো দেশে বদলি—আর এর সাথেই ফেলে যেতে হয় গড়ে তোলা এক জগৎ।

ফাতিমা (একজন তরুণীর কণ্ঠ, বয়স আনুমানিক ২০, কণ্ঠে চাপা আবেগ): আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন শব্দ হলো 'বিদায়'। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন আমার আব্বুর নাইজেরিয়া থেকে কাতারে পোস্টিং হয়। আমার সেই বন্ধুদের ছেড়ে আসতে যে কষ্ট হয়েছিল, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তারা ছিল আমার পরিবার। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যোগাযোগ রাখব। প্রথম কয়েক মাস রেখেওছিলাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, দূরত্বের কারণে, সেই সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে যায়। এটা আমার জীবনে তিনবার হয়েছে। এখন আমি নতুন বন্ধু বানাতে ভয় পাই। কারণ আমি জানি, একদিন হয়তো তাদেরও আমাকে বিদায় জানাতে হবে। এই অনুভূতিটা... এটা আপনাকে খুব একা করে দেয়।

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): এই বারবার বিদায়ের অভিজ্ঞতা TCK-দের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক খোলস তৈরি করতে পারে। তারা হয়তো খুব দ্রুত মানুষের সাথে মিশে যায়, কিন্তু গভীরভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে ভয় পায়। তাদের সম্পর্কগুলো হয়তো প্রশস্ত, কিন্তু গভীর নয়।

ন্যারেটর (ভয়েস-ওভার): থার্ড কালচার কিড—তারা একই সাথে সুবিধাপ্রাপ্ত এবং সুবিধাবঞ্চিত। তাদের জীবন বর্ণময়, কিন্তু জটিল। তারা বিশ্বের নাগরিক, কিন্তু তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। তারা হয়তো জানে না তাদের শেকড় কোথায়, কিন্তু তাদের ডালপালাগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই সংযুক্ত কিন্তু বিভক্ত পৃথিবীতে, হয়তো এই শেকড়হীন মানুষগুলোই আমাদের শেখাবে কীভাবে সাংস্কৃতিক সীমানা পেরিয়ে একে অপরকে বুঝতে হয়, এবং কীভাবে ভিন্নতার মধ্যেই একাত্মতার সন্ধান করতে হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!