সূচনা: আশির দশকের সেই স্বপ্ন
১৯৮০ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ তখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামে লিপ্ত। অর্থনীতির চাকা বলতে পাট আর চা। ঠিক সেই সময়ে, চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে। দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কর্পোরেশনের সাথে এক যুগান্তকারী চুক্তির মাধ্যমে ১৩০ জন বাংলাদেশি কর্মীকে কোরিয়ায় পাঠানো হয় আধুনিক পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে। তারা যখন দেশে ফিরে আসেন, তাদের সাথে করে নিয়ে আসেন শুধু তাই নয়, একটি স্বপ্ন—বিশ্বের বাজারে মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত পোশাক পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন।
এটিই ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বা রেডিমেড গার্মেন্টস (RMG) শিল্পের আনুষ্ঠানিক বীজ বপন। আজ, চার দশক পর, সেই ক্ষুদ্র বীজ পরিণত হয়েছে এক মহীরুহে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, যার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি, এবং যার সুতোয় বোনা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্য। কিন্তু এই যাত্রাপথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। এটি সাফল্য, সংগ্রাম, বেদনা এবং রূপান্তরের এক মহাকাব্য। চলুন, ফিরে দেখা যাক সেই সুতার গল্প, যা বদলে দিয়েছে একটি দেশের পরিচয়।
প্রথম পর্ব: আঁতুড়ঘরের সংগ্রাম এবং ধীরগতির বিকাশ (১৯৮০-১৯৯০)
দেশ গার্মেন্টস যখন যাত্রা শুরু করে, তখন বাংলাদেশে আধুনিক পোশাক তৈরির অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। দক্ষ শ্রমিক, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, এমনকি কাপড় কাটার কাঁচি পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। কিন্তু দেশ গার্মেন্টসের প্রশিক্ষিত কর্মীরাই হয়ে ওঠেন এই শিল্পের ভবিষ্যৎ কারিগর। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে নিজেরা কারখানা স্থাপন করেন এবং এই শিল্পকে প্রসারিত করতে সাহায্য করেন।
এই সময়ে বিশ্বব্যাপী একটি চুক্তি চালু ছিল, যার নাম মাল্টি-ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট (MFA)। এই চুক্তি অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে নির্দিষ্ট কোটায় পোশাক আমদানি করতে পারত। বাংলাদেশ, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে, এই কোটা সুবিধার আওতায় আসে। এটিই ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম বড় সুযোগ। পশ্চিমা ক্রেতারা যখন দেখলেন যে, বাংলাদেশে খুব কম খরচে পোশাক তৈরি করা সম্ভব, তখন তারা ধীরে ধীরে এদিকে ঝুঁকতে শুরু করলেন। আশির দশকের শেষে, দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে যায় এবং রপ্তানি আয় কয়েক মিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে। এটি ছিল এক বিশাল সম্ভাবনার প্রথম প্রস্ফুটন।
দ্বিতীয় পর্ব: স্বর্ণালী সময় এবং সামাজিক পরিবর্তন (১৯৯০-২০১০)
নব্বইয়ের দশক এবং নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক ছিল আরএমজি শিল্পের স্বর্ণালী সময়। এই সময়ে শিল্পটি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে এদেশের নারীরা। গ্রামের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে, কেবল দুটো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক ঢাকার আশেপাশে গড়ে ওঠা গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে যোগ দেন।
এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক अभूतপূর্ব সামাজিক পরিবর্তন। এই নারীরা কেবল কারখানার চাকাই ঘোরাননি, তারা নিজেদের ভাগ্য এবং সমাজের চাকাও ঘুরিয়ে দিয়েছেন। প্রথমবারের মতো তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পান। তাদের আয়ের টাকা গ্রামে পরিবারের কাছে যেতে শুরু করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলে। তাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার হার বাড়ে, বাল্যবিবাহের হার কমে, এবং পরিবার ও সমাজে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আরএমজি শিল্প কেবল একটি অর্থনৈতিক শক্তি ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল নারী ক্ষমতায়নের এক নীরব হাতিয়ার।
এই সময়েই গড়ে ওঠে দুটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক সংগঠন—বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ, যারা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করে। "মেড ইন বাংলাদেশ" ট্যাগটি তখন বিশ্বজুড়ে সস্তা শ্রমের সমার্থক হয়ে ওঠে।
তৃতীয় পর্ব: ট্র্যাজেডি এবং আত্মশুদ্ধির অগ্নিপরীক্ষা (২০১২-২০১৩)
সাফল্যের এই গল্পের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক অন্ধকার দিক। দ্রুত শিল্পায়নের চাপে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কর্মপরিবেশের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। কারখানার ভবনগুলো প্রায়শই ছিল অনিরাপদ, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল, এবং শ্রমিকদের অধিকার ছিল অবহেলিত। এই অবহেলার চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয় ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর, যখন আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস-এ ভয়াবহ আগুনে ১১৭ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান।
বিশ্ব এই ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আগেই, মাত্র পাঁচ মাস পর, ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল, ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। সাভারে রানা প্লাজা নামক একটি আটতলা ভবন ধসে পড়ে, যার ভেতরে থাকা পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানার ১,১৩৪ জনেরও বেশি শ্রমিক নিহত হন এবং আহত হন হাজার হাজার।
এই দুটি ঘটনা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অনিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ওয়ালমার্ট, এইচএন্ডএম, জারার মতো বড় বড় পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো চাপের মুখে পড়ে। একসময় মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের এই বুঝি এখানেই সমাপ্তি।
কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—আত্মশুদ্ধির এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, স্থানীয় কারখানা মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে গঠিত হয় দুটি যুগান্তকারী জোট—"অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ" এবং "অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি"। এই জোটগুলোর অধীনে বাংলাদেশের হাজার হাজার কারখানা পরিদর্শন করা হয়, ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি মেরামত করা হয়, এবং অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হয়। এটি ছিল এক বিশাল এবং ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ, কিন্তু এটিই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে একটি নতুন এবং টেকসই ভিত্তি প্রদান করে।
চতুর্থ পর্ব: ফিনিক্স পাখির উড়ান—সবুজ এবং টেকসই বিপ্লব (২০১৪-বর্তমান)
রানা প্লাজার ছাই থেকে যে শিল্পটি পুনর্জন্ম লাভ করেছে, তা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, নিরাপদ এবং টেকসই। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পোশাক কারখানাগুলোর আবাসস্থল। অবাক করার মতো বিষয় হলো, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সবুজ বা পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানাগুলোর একটি বড় অংশই এখন বাংলাদেশে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (USGBC) দেওয়া 'লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন' (LEED) সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে।
এই কারখানাগুলো কেবল শ্রমিকদের জন্য নিরাপদই নয়, এগুলো পানি ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের কাছে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আজকের বাংলাদেশ আর শুধু সস্তা টি-শার্ট বা প্যান্ট তৈরি করে না। শিল্পটি এখন প্রযুক্তি এবং দক্ষতার উপর বিনিয়োগ করছে। ডেনিম, জ্যাকেট, স্যুটের মতো উচ্চমূল্যের এবং জটিল পোশাক তৈরিতেও বাংলাদেশ তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে। অনেক কারখানা এখন স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটেড প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে এবং পণ্যের মান উন্নত করছে।
উপসংহার: ভবিষ্যতের পথচলা
চার দশক আগে যে যাত্রার শুরু হয়েছিল, তা আজ বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে এসেছে। আরএমজি শিল্প এখন দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি জোগান দেয় এবং প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করে, যাদের বেশিরভাগই নারী।
তবে ভবিষ্যতের পথটিও চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের কারণে ভবিষ্যতে শ্রমিকের চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো সস্তা শ্রমের বাজারে নতুন প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশকে এখন পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো, নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করা, এবং শ্রমিকদের দক্ষতাকে আরও উন্নত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
একটি সুতার গল্প দিয়ে যার শুরু, তা আজ মিলিয়ন মানুষের জীবন ও একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই গল্প প্রমাণ করে, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সহনশীলতা এবং সঠিক সময়ে পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করার মাধ্যমে যেকোনো সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করা সম্ভব।