মাছবুস থেকে মুতাব্বাক: কুয়েতের রন্ধনশৈলীর গভীরে এক রসনা যাত্রা

0


মরুভূমির স্বাদ

কুয়েত। নামটি শুনলেই আমাদের মাথায় ভাসে তেলের খনি, উঁচু বিল্ডিং আর মরুভূমির ছবি। কিন্তু এই আধুনিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধময় জগৎ—কুয়েতের ঐতিহ্যবাহী রন্ধনশৈলী। এটি এমন এক জগৎ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেদুইনদের যাযাবর জীবন, পারস্যের রাজকীয় স্বাদ এবং ভারতের মশলার পথের বাণিজ্য—এই তিনের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে।

আজ আমি, আপনার রসনা পথের গাইড, আপনাকে নিয়ে যাব কুয়েতের সেই অন্দরমহলে। আমরা কোনো ফাইভ-স্টার হোটেলের বুফেতে যাব না। আমরা যাব সেইসব জায়গায়, যেখানে কুয়েতের আসল আত্মাটি রান্না হয়—পুরনো বাজারের ধোঁয়া ওঠা রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে একজন কুয়েতি দাদির রান্নাঘর পর্যন্ত। চলুন, শুরু করা যাক আমাদের এই গ্যাস্ট্রোনমিক ট্যুর।

প্রথম কোর্স: জাতীয় গর্ব—মাছবুস (Machboos)

আপনি যদি কুয়েতের মানুষকে জিজ্ঞেস করেন তাদের একটি মাত্র খাবারের নাম বলতে, যা তাদের পরিচয়কে তুলে ধরে, তবে ৯৯ শতাংশ উত্তর হবে 'মাছবুস'। এটি কেবল একটি খাবার নয়, এটি তাদের উৎসব, তাদের আতিথেয়তা এবং তাদের পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক।

  • দর্শন: মাছবুস দেখতে অনেকটা আমাদের বিরিয়ানি বা পোলাওয়ের মতো, কিন্তু এর স্বাদ এবং দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর মূল ভিত্তি হলো বাসমতী চাল, যা বিভিন্ন মশলা (যেমন: লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, লুমী বা শুকনো লেবু) এবং জাফরানের সাথে রান্না করা হয়, যা একে একটি সুন্দর সোনালী রঙ এবং স্বর্গীয় সুগন্ধ দেয়। এর সাথে থাকে অত্যন্ত নরম এবং রসালো মাংস—হয় মুরগি (দিয়াইয়), খাসি (লাহাম), বা মাছ (সামাক)।

  • স্বাদের ব্যবচ্ছেদ: প্রথম কামড়েই আপনি পাবেন মশলার এক হালকা কিন্তু গভীর উষ্ণতা। বিরিয়ানির মতো এটি অতিরিক্ত মশলাদার বা ঝাল নয়। এখানকার তারকা হলো 'লুমী' বা কালো শুকনো লেবু, যা পুরো ডিশটিকে একটি হালকা টক এবং ধোঁয়াটে (Smoky) স্বাদ দেয়, যা অন্য কোনো খাবারে পাওয়া যায় না। মাংসটা এমনভাবে রান্না করা হয় যে, তা কাঁটাচামচের ছোঁয়াতেই হাড় থেকে আলাদা হয়ে যায়।

  • পরিবেশন: মাছবুস পরিবেশন করা হয় একটি বিশাল থালিতে, যার উপর ছড়িয়ে দেওয়া থাকে ভাজা পেঁয়াজ, কিশমিশ এবং মটরশুঁটি। এর সাথে পরিবেশন করা হয় 'দাক্কুস' (Daqqus) নামক একটি মসৃণ এবং কিছুটা টক টমেটো সস, যা এই খাবারের স্বাদকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

  • কোথায় খাবেন: সবচেয়ে খাঁটি স্বাদের জন্য, কোনো কুয়েতি পরিবারের দাওয়াতের বিকল্প নেই। তবে, মুবারাকিয়া বাজারের ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁগুলোতেও আপনি অসাধারণ মাছবুসের স্বাদ পাবেন।

দ্বিতীয় কোর্স: হৃদয়ের আরাম—হারিস এবং জিরিশ (Harees and Jareesh)

এই দুটি ডিশ হলো কুয়েতের 'কমফোর্ট ফুড'। এগুলো প্রায় প্রতিটি রমজান মাসে বা শীতের সন্ধ্যায় কুয়েতিদের ঘরে রান্না হয়।

  • হারিস (Harees): এটি একটি অত্যন্ত ধীরগতিতে রান্না করা ডিশ। গম এবং মাংস (সাধারণত খাসি) একসাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রান্না করা হয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত দুটোই গলে গিয়ে একটি ঘন, মসৃণ এবং আঠালো পরিজের মতো তৈরি হয়। এর উপর দারুচিনির গুঁড়ো এবং গরম ঘি ছড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। এর স্বাদ হালকা, কিন্তু অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক এবং পুষ্টিকর।

  • জিরিশ (Jareesh): এটিও গমের একটি ডিশ, কিন্তু এখানে গমকে পিষে ভাঙা হয় ( অনেকটা আমাদের ডালিয়ার মতো)। এটি পেঁয়াজ, মশলা এবং মুরগি বা খাসির মাংসের সাথে রান্না করা হয়। হারিসের চেয়ে এর টেক্সচার কিছুটা দানাদার।

এই খাবারগুলো হয়তো দেখতে খুব আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু এগুলো হলো সেইসব খাবার, যা আত্মার আরাম দেয়।

তৃতীয় কোর্স: সমুদ্রের স্বাদ—মুতাব্বাক সামাক (Mutabbaq Samak)

কুয়েতের ইতিহাস সমুদ্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই, তাদের রন্ধনশৈলীতে মাছের একটি বিশেষ স্থান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

  • দর্শন: 'মুতাব্বাক সামাক' মানে হলো 'লেয়ার্ড ফিশ' বা স্তরে স্তরে সাজানো মাছ। এখানে, কুয়েতের জনপ্রিয় মাছ 'জুবেইদি' (Zubaidi - Pomfret) বা 'হামুর' (Hamour - Grouper)-কে মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করে ভেজে নেওয়া হয়। এরপর, মশলাদার এবং ভাজা পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা ভাতের উপর মাছটিকে রেখে 'দমে' রান্না করা হয়।

  • স্বাদের বৈশিষ্ট্য: মাছের তাজা স্বাদ এবং ভাতের সুগন্ধি মশলার এক অসাধারণ সমন্বয় ঘটে এই ডিশে। মাছের উপরে দেওয়া ভাজা পেঁয়াজ এবং কিশমিশ একটি মিষ্টি ভাব নিয়ে আসে।

চতুর্থ কোর্স: মিষ্টিমুখ—ঘেরস ওগাইলি এবং লুগাইমাত (Gers Ogaily and Luqaimat)

  • ঘেরস ওগাইলি (Gers Ogaily): এটি একটি ঐতিহ্যবাহী কুয়েতি কেক। এর প্রধান উপাদান হলো জাফরান, এলাচ এবং তিল। এর রঙ হয় উজ্জ্বল হলুদ এবং এর স্বাদ হয় অত্যন্ত সুগন্ধময়। চায়ের সাথে খাওয়ার জন্য এটি একটি পারফেক্ট নাস্তা।

  • লুগাইমাত (Luqaimat): এটি অনেকটা আমাদের 'তেলে ভাজা পিঠা' বা ডোনাটের ছোট ভাই। ময়দার তৈরি ছোট ছোট বল সোনালী করে ভেজে, সেগুলোকে খেজুরের সিরা বা চিনির সিরায় ডুবিয়ে পরিবেশন করা হয়। বাইরেটা মুচমুচে আর ভেতরটা নরম—রমজান মাসে ইফতারের টেবিলে এটি একটি অপরিহার্য আইটেম।

চূড়ান্ত রায়: কুয়েতের রন্ধনশৈলী তার চাকচিক্য বা জটিলতার জন্য বিখ্যাত নয়। এর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এর সরলতা, এর উষ্ণতা এবং এর আতিথেয়তার মধ্যে। এটি এমন এক খাবার, যা আপনাকে কেবল শারীরিকভাবেই না, মানসিকভাবেও তৃপ্ত করবে। আপনি যদি একজন প্রবাসী হিসেবে কুয়েতকে সত্যিকার অর্থে জানতে চান, তাহলে ফাস্ট-ফুড চেইনগুলোকে পাশ কাটিয়ে, একবার অন্তত এই ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর স্বাদ নিন। আমি নিশ্চিত, আপনি নিরাশ হবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!