বিশেষ প্রতিবেদন, ২২ সেপ্টেম্বর:
আপনি হয়তো ভাবছেন, এটা ২০২৫ সাল, মানুষ মঙ্গলে রোবট পাঠাচ্ছে, আর এখনও কি কেউ বিশ্বাস করে যে পৃথিবী সমতল? উত্তরটি আশ্চর্যজনকভাবে, হ্যাঁ। ইন্টারনেটের যুগে, 'ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি' এবং এর সমর্থকরা এক নতুন এবং শক্তিশালী রূপে ফিরে এসেছে। ইউটিউব, ফেসবুক এবং বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে, তারা তাদের তত্ত্বগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা অনেক সাধারণ মানুষকেও দ্বিধায় ফেলে দেয়।
তারা দাবি করে, নাসা এবং বিশ্বের অন্যান্য সরকারগুলো এক বিশাল ষড়যন্ত্রের অংশ, যা আমাদের কাছ থেকে পৃথিবীর আসল আকৃতি লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাদের এই দাবিগুলোর পেছনে যুক্তি বা প্রমাণ কী? এবং বিজ্ঞানই বা এই বিষয়ে কী বলে? এই প্রতিবেদনে, আমরা কোনো রকম উপহাস না করে, একজন নিরপেক্ষ তদন্তকারীর মতো ফ্ল্যাট আর্থারদের প্রধান যুক্তিগুলো তুলে ধরব এবং সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিয়ে বিশ্লেষণ বা 'ডিবান্ক' করব।
ষড়যন্ত্রের মূল ভিত্তি: কেন এই অবিশ্বাস? ফ্ল্যাট আর্থ তত্ত্বে বিশ্বাস করার পেছনে বিজ্ঞানের চেয়েও বেশি কাজ করে মনোবিজ্ঞান।
সরকারের প্রতি অবিশ্বাস: অনেকেই সরকার এবং নাসার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সত্য লুকিয়ে রাখে।
একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অংশ হওয়ার অনুভূতি: ফ্ল্যাট আর্থ কমিউনিটিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে, তারা নিজেদেরকে এমন এক বিশেষ জ্ঞানী গোষ্ঠীর অংশ বলে মনে করেন, যারা 'প্রকৃত সত্য'টি জানে, যা বাকি 'ভেড়ার পাল' (Sheeple) জানে না।
সরল ব্যাখ্যার প্রতি আকর্ষণ: পৃথিবী একটি জটিল জায়গা। মহাকর্ষ, আপেক্ষিকতা—এইসব বোঝা কঠিন। এর চেয়ে, পৃথিবী একটি সমতল চাকতি, যার উপরে একটি গম্বুজ (Firmament) আছে—এই ধারণাটি বোঝা অনেক সহজ।
ফ্ল্যাট আর্থারদের প্রধান 'প্রমাণ' এবং বিজ্ঞানের উত্তর
"প্রমাণ" ১: "আমি যখন সমুদ্রের দিকে তাকাই, বা সমতলে দাঁড়াই, তখন তো আমি কোনো বক্রতা দেখি না। সবকিছুই তো সমতল মনে হয়।"
কেন এটি ভুল (বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা):
বিশালতার সমস্যা: পৃথিবী এতটাই বিশাল যে, আমাদের ক্ষুদ্র মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বক্রতা বোঝা প্রায় অসম্ভব। আপনি যদি একটি বিশাল ফুটবলের উপর একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার মতো বসে থাকেন, তাহলে আপনার কাছেও ফুটবলটিকে সমতলই মনে হবে।
** দিগন্তরেখা (Horizon):** আপনি যদি একটি উঁচু জায়গা থেকে, যেমন—একটি পাহাড়ের চূড়া বা একটি উঁচু দালান থেকে, সমুদ্রের দিকে তাকান, তাহলে আপনি একটি স্পষ্ট বক্র দিগন্তরেখা দেখতে পাবেন। এছাড়াও, যখন একটি জাহাজ দূর থেকে আপনার দিকে আসে, তখন আপনি প্রথমে তার মাস্তুল এবং পরে পুরো জাহাজটিকে দেখতে পান। যদি পৃথিবী সমতল হতো, তাহলে আপনি শুরু থেকেই পুরো জাহাজটিকে একটি ছোট বিন্দু হিসেবে দেখতে পেতেন।
"প্রমাণ" ২: "মহাকর্ষ একটি মিথ্যা। জিনিসপত্র নিচে পড়ে কারণ সেগুলো বাতাসের চেয়ে বেশি ঘন (Density)। পৃথিবী একটি চাকতির মতো উপরের দিকে ৯.৮ মি/সে² ত্বরণে ছুটে চলেছে, যা মহাকর্ষের বিভ্রান্তি তৈরি করে।"
কেন এটি ভুল:
অসম্ভব গতি: যদি পৃথিবী ক্রমাগত উপরের দিকে এই ত্বরণে চলতে থাকত, তাহলে কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই এর গতি আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছে যেত, যা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী অসম্ভব।
ঘনত্বের যুক্তি খণ্ডন: এই যুক্তি অনুযায়ী, একটি হিলিয়াম বেলুন উপরে ওঠে কারণ এটি বাতাসের চেয়ে কম ঘন। কিন্তু একটি ভ্যাকুয়াম চেম্বারের ভেতরে, যেখানে কোনো বাতাস নেই, সেখানেও যদি একটি বোলিং বল এবং একটি পাখির পালক একসাথে ফেলা হয়, তারা একই সাথে নিচে পড়ে। এটিই প্রমাণ করে যে, মহাকর্ষ বস্তুর ভরের উপর কাজ করে, ঘনত্বের উপর নয়।
"প্রমাণ" ৩: "নাসার সমস্ত ছবি এবং ভিডিও ভুয়া। এগুলো সবই কম্পিউটার-জেনারেটেড ইমেজ (CGI)। চাঁদে যাওয়ার ঘটনাটিও একটি সাজানো নাটক ছিল।"
কেন এটি ভুল:
অকল্পনীয় ষড়যন্ত্র: চাঁদে যাওয়ার অ্যাপোলো মিশনে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ কাজ করেছিল। এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে নিয়ে এত বড় একটি মিথ্যা কয়েক দশক ধরে লুকিয়ে রাখাটা প্রায় অসম্ভব।
প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের প্রমাণ: স্নায়ুযুদ্ধের সময়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি চাঁদে যাওয়ার ঘটনাটি মিথ্যা হতো, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নই হতো প্রথম দেশ, যারা এই মিথ্যাটিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরত। কিন্তু তারাও এই মিশনটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থা: আজ শুধু নাসা নয়, ইউরোপ, চীন, ভারত, জাপান—সবারই নিজস্ব মহাকাশ সংস্থা এবং স্যাটেলাইট রয়েছে। তারা সবাই তাদের নিজেদের তোলা ছবি থেকে নিশ্চিত করেছে যে, পৃথিবী গোলাকার।
আপনি নিজে কীভাবে প্রমাণ করবেন যে পৃথিবী গোলাকার?
আপনাকে নাসা বা কোনো বিজ্ঞানীর কথা বিশ্বাস করতে হবে না। কিছু সহজ পরীক্ষা আপনি নিজেই করতে পারেন।
চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করুন: চন্দ্রগ্রহণের সময়, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে। সেই ছায়াটি সর্বদা একটি বৃত্তের চাপের মতো বাঁকা হয়। একমাত্র একটি গোলাকার বস্তুই যেকোনো কোণ থেকে একটি বৃত্তাকার ছায়া তৈরি করতে পারে।
দুটি ভিন্ন শহরে ছায়ার পরিমাপ: প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদ এরাটোস্থেনিস এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। একই দিনে, একই সময়ে, দুটি ভিন্ন শহরে (যারা একে অপরের থেকে অনেকটা উত্তরে বা দক্ষিণে অবস্থিত) দুটি লাঠির ছায়ার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করুন। যদি পৃথিবী সমতল হতো, তাহলে ছায়ার দৈর্ঘ্য একই হতো। কিন্তু পৃথিবী গোলাকার হওয়ায়, ছায়ার দৈর্ঘ্যে পার্থক্য দেখা যাবে, এবং এই পার্থক্য ব্যবহার করে আপনি পৃথিবীর পরিধিও প্রায় নির্ভুলভাবে হিসাব করতে পারবেন।
উপসংহার: ফ্ল্যাট আর্থ তত্ত্বটি কোনো বৈজ্ঞানিক বিতর্ক নয়। এটি হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার প্রতি এক গভীর অবিশ্বাস প্রকাশ। ইন্টারনেটের যুগে, যেখানে যেকোনো তথ্য, সত্য বা মিথ্যা, সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেখানে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হলো একজন 'ফ্যাক্ট-চেকার' বা সত্য যাচাইকারীর ভূমিকা পালন করা।
বিজ্ঞান কোনো বিশ্বাসের নাম নয়। এটি প্রমাণ, পর্যবেক্ষণ এবং ক্রমাগত প্রশ্ন করার একটি প্রক্রিয়া। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই, আমরা জানি যে, আমরা একটি সমতল চাকতির উপর বাস করি না, আমরা বাস করি মহাকাশে ভেসে থাকা এক অসাধারণ নীল মার্বেলের উপর।