সময়ের গোলকধাঁধা: ব্যস্ততা এবং উৎপাদনশীলতার মধ্যে কথোপকথন

0



চরিত্র:

  • আরিফ: একজন তরুণ, উদ্যমী কিন্তু ক্রমাগত চাপে থাকা পেশাজীবী।

  • জনাব হাশেম: একজন প্রবীণ, অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী পরামর্শদাতা।

**(দৃশ্য: একটি পার্কের বেঞ্চ। পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো। আরিফকে বেশ ক্লান্ত এবং চিন্তিত দেখাচ্ছে। জনাব হাশেম তার পাশে এসে বসেন।)

জনাব হাশেম: কী খবর, আরিফ? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন পুরো পৃথিবীর বোঝাটা তোমার কাঁধেই।

আরিফ: (একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আর বলবেন না, হাশেম ভাই। আমি буквально ডুবে যাচ্ছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করি, কিন্তু দিনশেষে মনে হয় কিছুই শেষ করতে পারিনি। আমার টু-ডু লিস্টটা কমার বদলে দিন দিন আরও লম্বা হচ্ছে। আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি, কিন্তু কোনো কিছুই ঠিকমতো এগোচ্ছে না।

জনাব হাশেম: (মৃদু হেসে) আরিফ, তুমি কি ব্যস্ত, নাকি উৎপাদনশীল?

আরিফ: (অবাক হয়ে) এর মধ্যে আবার পার্থক্য কী? ব্যস্ত থাকা মানেই তো কাজ করা, মানেই তো উৎপাদনশীল হওয়া, তাই না?

জনাব হাশেম: এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুলটা হয়। ধরো, একজন কাঠুরে সারাদিন ধরে একটি ভোঁতা কুড়াল দিয়ে গাছ কাটার চেষ্টা করছে। সে প্রচণ্ড ব্যস্ত, সে ঘামছে, সে কঠোর পরিশ্রম করছে। কিন্তু তার পাশের আরেকজন কাঠুরে যদি প্রথম এক ঘণ্টা সময় নিয়ে তার কুড়ালটি ধারালো করে নেয়, এবং তারপর গাছ কাটে, তাহলে কে বেশি গাছ কাটতে পারবে?

আরিফ: অবশ্যই দ্বিতীয়জন।

জনাব হাশেম: ঠিক তাই। প্রথম কাঠুরে ছিল 'ব্যস্ত'। দ্বিতীয়জন ছিল 'উৎপাদনশীল'। ব্যস্ততা হলো কেবল শক্তি ব্যয় করা, আর উৎপাদনশীলতা হলো সঠিক জায়গায়, সঠিক কৌশলে শক্তি ব্যয় করে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করা। তোমার সমস্যাটা হলো, তুমি সারাদিন ধরে একটি ভোঁতা কুড়াল দিয়ে কাজ করে যাচ্ছ।

আরিফ: তাহলে... আমার কুড়ালটা ধারালো করার উপায় কী? আমি কীভাবে বুঝব কোন কাজটি আগে করা উচিত আর কোনটি পরে? সবকিছুই তো জরুরি মনে হয়।

জনাব হাশেম: চলো, একটা সহজ কৌশল নিয়ে কথা বলি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করতেন। তিনি কাজগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করতেন। ভাবো, তোমার সামনে চারটি বাক্স আছে।

  • প্রথম বাক্স: জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ (Urgent and Important)।

  • দ্বিতীয় বাক্স: গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরি নয় (Important but Not Urgent)।

  • তৃতীয় বাক্স: জরুরি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয় (Urgent but Not Important)।

  • চতুর্থ বাক্স: জরুরিও নয়, গুরুত্বপূর্ণও নয় (Neither Urgent nor Important)।

এখন বলো তো, তোমার বেশিরভাগ সময় কোন বাক্সের কাজগুলো করতে চলে যায়?

আরিফ: (কিছুক্ষণ ভেবে) সম্ভবত প্রথম আর তৃতীয় বাক্সের কাজগুলো করতে। যেমন—হঠাৎ আসা ইমেইলের উত্তর দেওয়া, বসের ডাকা মিটিংয়ে যাওয়া, ফোনের ক্রমাগত নোটিফিকেশন চেক করা। এই কাজগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মনোযোগ দাবি করে।

জনাব হাশেম: ঠিক ধরেছ। বেশিরভাগ মানুষই 'জরুরি' কাজগুলোর পেছনে ছুটে বেড়ায়, কারণ সেগুলো আমাদের চোখে বেশি পড়ে এবং এক ধরনের অ্যাড্রেনালিন রাশ তৈরি করে। কিন্তু সফল মানুষেরা তাদের বেশিরভাগ সময় এবং শক্তি ব্যয় করে দ্বিতীয় বাক্সের কাজগুলোতে—যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জরুরি নয়।

আরিফ: যেমন?

জনাব হাশেম: যেমন—নতুন কিছু শেখা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা, স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া, সম্পর্কগুলোকে সময় দেওয়া, তোমার ওই কুড়ালটা ধারালো করা। এই কাজগুলো তোমাকে তাৎক্ষণিক কোনো ফলাফল দেবে না, কিন্তু এগুলোই তোমার ভবিষ্যতের ভিত তৈরি করে দেয়। তুমি যদি তোমার বেশিরভাগ সময় দ্বিতীয় বাক্সের কাজগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারো, তাহলে দেখবে প্রথম বাক্সে (জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ সংকট) কাজের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে, কারণ তুমি আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে।

আরিফ: বাহ্! এটা তো দারুণ একটা দৃষ্টিকোণ। কিন্তু আমি যদি দ্বিতীয় বাক্সের কাজ করতে যাই, তাহলে তো তৃতীয় বাক্সের জরুরি কাজগুলো জমে যাবে। যেমন—অনেক ইমেইল বা ফোন কল, যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ না হলেও উত্তর না দিলে চলে না।

জনাব হাশেম: এর জন্যও উপায় আছে। তৃতীয় বাক্সের কাজগুলোকে যতটা সম্ভব দ্রুত শেষ করতে হবে, অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হবে (Delegate), অথবা স্বয়ংক্রিয় (Automate) করে ফেলতে হবে। আর চতুর্থ বাক্সের কাজগুলো (যেমন: অপ্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা) তোমার সময় এবং শক্তি নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। ওগুলোকে তোমার জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। আচ্ছা, আরেকটা বিষয় বলো। তুমি যখন কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে বসো, তখন কি একটানা মনোযোগ দিয়ে করতে পারো?

আরিফ: না, সেখানেই তো আসল সমস্যা। একটা রিপোর্ট লিখতে বসি, পাঁচ মিনিট পর একটা ইমেইল আসে, সেটার উত্তর দিই। তারপর ফেসবুক থেকে একটা নোটিফিকেশন আসে, সেটা দেখতে যাই। তারপর কলিগ এসে একটা প্রশ্ন করে... দিনশেষে দেখি, রিপোর্টটার প্রথম প্যারাগ্রাফও ঠিকমতো লেখা হয়নি।

জনাব হাশেম: একে বলে 'কন্টেক্সট সুইচিং'। আমাদের মস্তিষ্ক মাল্টিটাস্কিং করার জন্য তৈরি হয়নি। যখন তুমি এক কাজ থেকে আরেক কাজে লাফিয়ে বেড়াও, তখন প্রতিবার তোমার মস্তিষ্ককে নতুন করে ফোকাস তৈরি করতে হয়, যা প্রচুর মানসিক শক্তি অপচয় করে। এর সমাধান হলো 'পোমোডোরো টেকনিক'।

আরিফ: পোমোডোরো? ওটা আবার কী?

জনাব হাশেম: এটা খুব সহজ একটি পদ্ধতি। তুমি একটি টাইমার ২৫ মিনিটের জন্য সেট করবে। এই ২৫ মিনিট তুমি তোমার ফোন, ইমেইল, নোটিফিকেশন—সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে শুধুমাত্র একটি কাজে মনোযোগ দেবে। ২৫ মিনিট পর, টাইমার বাজলে, তুমি ৫ মিনিটের একটি বিরতি নেবে। এই সময়ে তুমি একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারো বা পানি খেতে পারো। এভাবে চারটি 'পোমোডোরো' সেশন করার পর, তুমি একটি লম্বা বিরতি (১৫-৩০ মিনিট) নেবে। এই পদ্ধতিটি তোমার মস্তিষ্ককে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে প্রশিক্ষণ দেয়।

আরিফ: শুনতে তো বেশ কার্যকর মনে হচ্ছে। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। আচ্ছা, হাশেম ভাই, আমার আরও একটা সমস্যা আছে। আমার মনে হয়, একটা কাজ শেষ করার জন্য আমার হাতে जितना বেশি সময় থাকে, আমার তত বেশি দেরি হয়। পরীক্ষার আগের রাতের মতো অবস্থা।

জনাব হাশেম: (হেসে) একে বলে 'পার্কিনসন্স ল'। এর মূল কথা হলো, "একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য যতটা সময় বরাদ্দ করা হয়, কাজটি ঠিক ততটা সময়জুড়েই বিস্তৃত হয়।" তোমাকে যদি একটি রিপোর্ট লেখার জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়, তুমি পুরো সপ্তাহ ধরেই কাজটি করবে। আর যদি একই কাজের জন্য দুই দিন সময় দেওয়া হয়, তুমি দেখবে দুই দিনেই সেটি করে ফেলেছ। তাই, প্রতিটি কাজের জন্য কৃত্রিমভাবে একটি কঠোর এবং বাস্তবসম্মত ডেডলাইন তৈরি করো। এটি তোমাকে অপ্রয়োজনীয় গড়িমসি থেকে বাঁচাবে।

আরিফ: হাশেম ভাই, আপনার কথাগুলো শোনার পর আমার মনে হচ্ছে আমি যেন সময়ের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, আর আপনি আমাকে বাইরের পথটা দেখিয়ে দিলেন। ব্যস্ততার অভিনয় না করে, এখন থেকে আমি সত্যিই উৎপাদনশীল হওয়ার চেষ্টা করব। আমার কুড়ালটা ধারালো করার সময় এসেছে।

জনাব হাশেম: মনে রেখো, আরিফ, সময় আমাদের সকলের জন্যই সমান—দিনে ২৪ ঘণ্টা। পার্থক্য গড়ে দেয় শুধু তার সঠিক ব্যবহার। তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো তোমার মনোযোগ। যেখানে তোমার মনোযোগ যাবে, সেখানেই তোমার শক্তি প্রবাহিত হবে। তাই, তোমার মনোযোগকে বিজ্ঞের মতো ব্যবহার করো।

**(আরিফের চোখেমুখে এখন আর আগের সেই ক্লান্তি বা দুশ্চিন্তা নেই। তার বদলে দেখা যাচ্ছে এক নতুন উদ্যম এবং আশার আলো। সে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে উঠে দাঁড়ায়।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!