সুয়েজ খাল সংকট: যেভাবে একটি জাহাজ পুরো বিশ্বকে থামিয়ে দিয়েছিল

0



লোহিত সাগর, মিশর। ২৩ মার্চ, ২০২১। বিশাল কন্টেইনার জাহাজ 'এভার গিভেন' (Ever Given) তার ৪৩ জন ক্রু নিয়ে ধীর গতিতে সুয়েজ খালের দক্ষিণ প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এটি ছিল একটি রুটিন যাত্রা। চীনের বন্দর থেকে নেদারল্যান্ডস-এর রটারডামের দিকে যাত্রা করা এই জাহাজটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ—লম্বায় চারটি ফুটবল মাঠের সমান এবং এর উপর প্রায় ২০,০০০ কন্টেইনারের স্তূপ, যা দিয়ে অনায়াসে একটি ছোটখাটো শহর তৈরি করে ফেলা যায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং মিশরীয় পাইলটরা জানতেন, আগামী ১২ ঘণ্টা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এই সংকীর্ণ এবং ঐতিহাসিক জলপথটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাড়ি দিতে হবে।

কিন্তু তারা যা জানতেন না, তা হলো—এই রুটিন যাত্রাটি কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বিশ্বব্যাপী দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। এভার গিভেন কেবল সুয়েজ খালেই আটকা পড়বে না, এটি বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধান ধমনীটিকেও ব্লক করে দেবে, যার ফলে প্রতিদিন প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আটকে পড়বে এবং পুরো বিশ্ব এক অভূতপূর্ব সাপ্লাই চেইন সংকটের মুখে পড়বে।

এটি সেই ছয় দিনের রুদ্ধশ্বাস গল্প, যখন একটি মাত্র জাহাজ পুরো পৃথিবীকে জিম্মি করে রেখেছিল।

সেই ভয়ংকর ৪০ সেকেন্ড সেদিন সকাল থেকেই আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল। প্রায় ৭৫ কিলোমিটার বেগে মরুভূমির বালুঝড় বইছিল, যা জাহাজের নিয়ন্ত্রণকে কঠিন করে তুলেছিল। সকাল ৭:৪০ নাগাদ, এভার গিভেন যখন খালের একটি সংকীর্ণ, একমুখী অংশে প্রবেশ করে, তখনই বিপর্যয়টি ঘটে। তীব্র বাতাসের ঝাপটায় জাহাজের সামনের এবং পেছনের অংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জাহাজের বিশাল আকার বাতাসের বিরুদ্ধে একটি পালের মতো কাজ করে। ক্যাপ্টেন এবং পাইলটরা মরিয়া হয়ে জাহাজটিকে সোজা করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জাহাজটির সামনের বাল্বাস বো (Bulbous Bow) খালের পূর্ব পাড়ের বালিতে সজোরে গেঁথে যায় এবং এর পেছনের অংশটি ঘুরে গিয়ে পশ্চিম পাড়ে আটকে পড়ে। আড়াআড়িভাবে, প্রায় ৩০০ মিটার চওড়া খালটিকে একটি বিশাল প্রাচীরের মতো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় এভার গিভেন। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। চারপাশে নেমে আসে এক অবিশ্বাস্য নীরবতা। ৪ লক্ষ টন ওজনের এই দানবটি এখন আক্ষরিক অর্থেই এক 'সমুদ্রের সৈকতে আটকে পড়া তিমি'।

বিশ্ব বাণিজ্যের হার্ট অ্যাটাক সুয়েজ খাল কোনো সাধারণ জলপথ নয়। এটি এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সামুদ্রিক পথ। এটি ব্যবহার করে, জাহাজগুলোকে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে যাওয়ার দীর্ঘ এবং বিপজ্জনক পথটি এড়ানো সম্ভব হয়, যা প্রায় দুই সপ্তাহ সময় এবং প্রচুর জ্বালানি সাশ্রয় করে। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশই এই খাল দিয়ে পরিবাহিত হয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০টিরও বেশি জাহাজ এই পথ ব্যবহার করে।

এভার গিভেন আটকে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, এর প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করে। খালের দুই প্রান্তে, লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরে, জাহাজের এক বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম তৈরি হতে শুরু করে। তেলবাহী ট্যাঙ্কার, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) বহনকারী জাহাজ, এবং হাজার হাজার কন্টেইনারে ভরা জাহাজ—সবাই আটকা পড়ে।

  • অর্থনৈতিক প্রভাব: বিশেষজ্ঞরা হিসাব কষতে শুরু করেন। অনুমান করা হয়, এই ব্লকেজের কারণে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতিদিন প্রায় ৯.৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ক্ষতি হচ্ছে। এই খবরটি বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারে এবং তেলের দামে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে।

  • সাপ্লাই চেইনের সংকট: আটকে পড়া কন্টেইনারগুলোতে ছিল সবকিছু—অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ, ফার্নিচার, পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, এমনকি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। যে কোম্পানিগুলো 'জাস্ট-ইন-টাইম' ইনভেন্টরি সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল ছিল, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জার্মানির গাড়ি প্রস্তুতকারক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা—সবাই তাদের কাঁচামাল বা তৈরি পণ্য সময়মতো পাঠাতে না পারার কারণে এক অভূতপূর্ব সংকটে পড়ে।

উদ্ধার অভিযান: ড্রেজার, টাগবোট এবং চাঁদের সাহায্য সুয়েজ ক্যানেল অথরিটি (SCA) এবং ডাচ উদ্ধারকারী সংস্থা স্মিট সালভেজ (Smit Salvage)-এর নেতৃত্বে এক বিশাল এবং জটিল উদ্ধার অভিযান শুরু হয়।

  • প্রথম চেষ্টা—ড্রেজিং: প্রথম কৌশল ছিল, জাহাজের সামনের অংশে যে বালি এবং কাদামাটি জমে আছে, সেগুলোকে ড্রেজার দিয়ে খনন করে সরানো। দুটি বিশাল ড্রেজার দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ধরে কাজ করে প্রায় ৩০,০০০ ঘন মিটার বালি সরিয়ে ফেলে।

  • দ্বিতীয় চেষ্টা—টাগবোট: একই সাথে, এক ডজনেরও বেশি শক্তিশালী টাগবোট এভার গিভেনকে সামনে এবং পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে এবং টেনে সরানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ৪ লক্ষ টনের এই দানবকে সরানোটা ছিল প্রায় একটি পাহাড়কে সরানোর মতোই কঠিন।

  • চূড়ান্ত আশা—'সুপারমুন' এবং উচ্চ জোয়ার: উদ্ধারকারী দলের চূড়ান্ত আশা ছিল সপ্তাহান্তের 'সুপারমুন' বা পূর্ণিমার কারণে সৃষ্ট উচ্চ জোয়ার। তারা জানতেন, এই সময়ে খালের পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেড়ে যাবে, যা জাহাজটিকে আলগা করার জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করবে।

পুরো বিশ্ব তখন স্যাটেলাইট এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে এই রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার অভিযানটি দেখছিল। ইন্টারনেটে, একটি ছোট খননকারী মেশিনের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়, যা বিশাল এভার গিভেনের সামনে অসহায়ভাবে বালি খনন করছিল—এই ছবিটিই যেন পুরো পরিস্থিতির এক নিখুঁত রূপক হয়ে উঠেছিল।

অবশেষে, ২৯ মার্চ, ছয় দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ারের সাহায্যে, টাগবোটগুলো এভার গিভেনকে তার বালির কারাগার থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। যখন জাহাজটি আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে এবং তার হর্ন বাজায়, তখন খালের তীরে থাকা মিশরীয় কর্মীরা এবং বিশ্বজুড়ে শিপিং ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

শিক্ষা এবং উত্তরাধিকার এভার গিভেনের এই সংকটটি ছিল বিশ্বায়নের যুগের জন্য এক বড় 'ওয়েক-আপ কল'। এটি আমাদের দেখিয়েছে যে, আমাদের বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাটি কতটা আন্তঃসংযুক্ত এবং একই সাথে কতটা ভঙ্গুর। একটি মাত্র দুর্ঘটনা, একটি মাত্র সংকীর্ণ জলপথে, পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

এই ঘটনার পর, অনেক কোম্পানিই তাদের সাপ্লাই চেইনকে আরও বৈচিত্র্যময় করার এবং শুধুমাত্র একটি রুটের উপর নির্ভরতা কমানোর কথা ভাবতে শুরু করেছে। সুয়েজ ক্যানেল অথরিটিও তাদের খালের সংকীর্ণ অংশগুলোকে আরও চওড়া করার জন্য একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

এভার গিভেনের গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগেও, আমরা এখনও প্রকৃতির শক্তি এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনার কাছে কতটা অসহায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!