শীতকাল। গ্রামের ভেতর গরম আলু ভর্তা, পান্তা ভাত আর কাঁচা মরিচ খাওয়ার ধুম চলছে। কিন্তু এই সুখের সময়েই শুরু হলো এক অদ্ভুত বিপত্তি। গ্রামের একে একে সবার মুরগি হারাতে লাগল। কারও ঘরে তিনটা মুরগি ছিল, সকালে উঠে দেখা যাচ্ছে দুটো নাই। কারও দশটা হাঁস-মুরগি, রাতারাতি অর্ধেক উধাও।
শুরুতে সবাই ভেবেছিল শিয়ালের কাজ। কিন্তু সমস্যা হলো— শিয়াল যদি খায়, তবে অন্তত পালক, হাড় বা রক্তের দাগ থাকত। কিন্তু এ কেসে কোনো দাগ-টাগ নেই, পুরো মুরগিটাই উধাও। মনে হচ্ছে মুরগিরা রাতের বেলা লুঙ্গি পরে কাবাব খেতে গিয়ে আর ফেরেনি!
সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো নাসির উদ্দিন। তার পোলট্রি ফার্মে পঞ্চাশটা মুরগি ছিল, এক সপ্তাহে কমে হলো পঁইত্রিশ। সে পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল, "এই গ্রামে চোর ঢুকছে, আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে আছি?!"
তখন গ্রামের মেম্বার একটা মিটিং ডাকল। হাটখোলার মাঠে মাইক ভাড়া করে ঘোষণা হলো— "আজ রাতেই মুরগি চোর ধরতে আমরা দলবদ্ধ পাহারা দেব।"
সেই রাতে শুরু হলো পাহারার মহাযজ্ঞ। গ্রামের ছেলেরা লাঠি হাতে, বুড়োরা বাঘা মশালের আলো হাতে, আর কিছু মাতব্বর হাতে গরম চা নিয়ে বসে থাকল। সবাই একসাথে স্লোগান দিল, "মুরগি বাঁচাও, গ্রাম বাঁচাও!"
প্রথম রাতেই দেখা গেল আসল নাটক। রাত দুইটার দিকে সেলিম মিয়ার খোঁয়াড় থেকে শব্দ এলো। সবাই দৌড়ে গেল। এক ঝটকায় দরজা খোলা হলো। ভেতরে দেখা গেল তিনটে মোটা মুরগি হাওয়া। কিন্তু চোর নাই!
হঠাৎ করেই পাশের খালে শব্দ হলো— "ঝপাং!"
সবাই টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল, একটা লুঙ্গি ভেজা ভেজা পানির ওপর ভাসছে। লুঙ্গিটা লাল রঙের, আর তাতে লেখা "Love Forever"।
গ্রামের লোকজন হা করে তাকিয়ে রইল। কুলসুম বুড়ি বলল, "হায় আল্লাহ! মুরগি চোর প্রেমও করে!"
এরপর থেকে গ্রামে ভয়ের চেয়ে মজার ছড়াছড়ি শুরু হলো। ছেলেপেলেরা গান বানিয়ে ফেলল—
"মুরগি গেলে দোষ নাই,
চোর যদি প্রেমিক হয়, তাই!"
দ্বিতীয় রাতে পাহারা দিতে গিয়ে খোদ মেম্বারই গণ্ডগোল করে বসলেন। তিনি একটা ঝোপ নড়তে দেখে চিৎকার করে উঠলেন, "চোর! ধর ধর!" সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখে— মেম্বারের নিজের গরু ঘাস খাচ্ছে। গ্রামের লোকজন হেসে কুটোপাটি। মেম্বার মুখ লাল করে বললেন, "ভাই ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু দোষটা গরুরও আছে, চোরের মতো কাজ করতেছিল।"
তৃতীয় রাতে আসল মজা হলো। এবার তারা ফাঁদ পাতল। মুরগির খাঁচার সামনে দড়ি দিয়ে একটা বাঁশ বাঁধল। বাঁশ টান দিলেই লাফিয়ে পড়ে ধরা দেবে।
রাত বারোটার দিকে হঠাৎ দেখা গেল কেউ একজন খাঁচার ভেতর হাত ঢুকাচ্ছে। দড়ি টানতেই "ঠাস" শব্দ করে বাঁশ পড়ে গেল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে— চোর হলো গ্রামেরই কাশেম আলী!
কিন্তু সমস্যা হলো, কাশেম আলী মুখে মুরগি চেপে ধরেছে, আর বগলের নিচে দুইটা মুরগি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক বন্দুক নিয়ে আছে।
সবাই চিৎকার করে উঠল, "ধরা খাইছিস, কাশেম!"
কাশেম থতমত খেয়ে বলল, "না না, আমি মুরগি চুরি করি নাই। এগুলা আমার কাছে নিজেরাই আসছিল।"
গ্রামের লোকজন হেসে গড়াগড়ি খায়। একজন বলে উঠল, "তাহলে তোকে আমরা মুরগির মোহিনী ডাকি।"
কাশেমকে মেম্বারের সামনে হাজির করা হলো। মেম্বার জিজ্ঞেস করলেন, "কেন চুরি করিস?"
কাশেম মাথা চুলকে বলল, "মেম্বার সাহেব, আসলে আমার স্ত্রী প্রতিদিন মুরগির মাংস খাওয়ার আবদার করে। বাজার থেকে কিনতে গেলে টাকা খরচ হয়। তাই ভাবলাম, প্রতিবেশীর মুরগিই যদি একটু ধার করি?"
এই উত্তর শুনে গ্রাম ফেটে পড়ল হাসিতে। মেম্বার নিজেও হেসে গড়িয়ে পড়লেন। শেষে সিদ্ধান্ত হলো— কাশেমকে শাস্তি দিতে হবে, কিন্তু কী শাস্তি?
তখন গ্রামে বুদ্ধিমান নামে খ্যাত হযরত আলী মঞ্চে উঠে ঘোষণা দিলেন, "কাশেমকে এক মাস প্রতিদিন গ্রামে হাঁটতে হবে একটা প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে, যাতে লেখা থাকবে— 'আমি মুরগি চোর, কিন্তু আমি নির্দোষ'।"
এমন অদ্ভুত শাস্তি শোনার পর সবাই হাততালি দিল।
পরদিন সকাল থেকে কাশেম সত্যি সত্যিই প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে লাগল। গ্রামজুড়ে হইচই পড়ে গেল। শিশুরা তাকে দেখে মুরগির ডাক দেয়— "কক কক কক!" মেয়েরা হাসতে হাসতে বলে, "কাশেম ভাই, আজ কি বউয়ের জন্য মুরগি মারছেন?"
কিন্তু এখানেই শেষ না। এক সপ্তাহ পর গ্রামে আরেক বিপদ হলো। এবার নাসির উদ্দিন আবার চিৎকার শুরু করল, "আমার ফার্ম থেকে আবার মুরগি নাই হয়ে গেছে।"
সবাই অবাক! কাশেম তো ধরা খেয়েছে, এবার আবার কার কাজ?
রাতেই পাহারা দেওয়া হলো। হঠাৎ তারা দেখে, কাশেম তো গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েই ঘুমাচ্ছে, কিন্তু মুরগি তবুও হারাচ্ছে। তখন সন্দেহ হলো— আসলে চোর একা না, চোরের সিন্ডিকেট আছে!
কয়েক রাত তদন্ত করে তারা আবিষ্কার করল— আসল চোর হচ্ছে গ্রামের দুই বখাটে ছেলে, রবিউল আর ফজলু। তারা কাশেমকে ফাঁসিয়ে নিজেদের জন্য মুরগি সরাত। কাশেম ধরা পড়ার পর তার প্ল্যাকার্ড দেখে তারা হেসে খুন হতো, আর নিজেদের দোষ আড়াল করত।
শেষে যখন তাদের হাতে-নাতে ধরা হলো, তখন গ্রামজুড়ে আবার হাসির ঝড়। রবিউল বলল, "আসলে আমরা মুরগি খেতাম না, বেচে টাকা দিয়ে প্রেমিকা ঘোরাতাম।" ফজলু বলল, "আমি তো মুরগি দিয়ে বউকে গয়না কিনে দিয়েছি!"
এই উত্তর শোনার পর গ্রামের মেয়েরা দাঁত বের করে হাসল। ছেলেরা গান ধরল—
"মুরগি দিয়ে গয়না হয়,
প্রেমিক বেচে সোনা কয়!"
অবশেষে মেম্বার রায় দিলেন— "রবিউল আর ফজলুকে এক মাস বিনামূল্যে গ্রামের সব ঘরে ডিম বিলি করতে হবে। আর কাশেমকে প্ল্যাকার্ড খুলে দেওয়া হলো, তবে তাকে আজীবন 'মুরগি চোর' নামেই ডাকা হবে।"
এরপর থেকে গ্রামে যখনই কেউ মজার ঘটনা ঘটায়, সবাই বলে— "এ তো দেখি মুরগি চোরের কাণ্ড!"