কুয়েতে প্রবাসীদের জন্য বড় দুঃসংবাদ: ১২০টি ফ্রিল্যান্স পেশা এখন শুধুমাত্র কুয়েতিদের জন্য সংরক্ষিত!

0

 


ভূমিকা: কুয়েতের শ্রমবাজারে প্রবাসী কর্মীদের জন্য আরও একটি বড় পরিবর্তনের ঘোষণা এলো। দেশটির সরকার ‘কুয়েতীকরণ’ নীতির অংশ হিসেবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপে দেশটিতে কর্মরত প্রবাসী এবং এমনকি জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্যও ১২০টি ফ্রিল্যান্স বা স্বাধীন পেশাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই আইন অনুযায়ী, এখন থেকে উল্লেখিত পেশাগুলোতে শুধুমাত্র কুয়েতি নাগরিকরাই কাজ করার সুযোগ পাবেন। এই সিদ্ধান্তটি কুয়েতে বসবাসরত হাজার হাজার দক্ষ প্রবাসী, বিশেষ করে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের উপর এক বিরাট প্রভাব ফেলবে, যারা তাদের মূল চাকরির পাশাপাশি বা স্বাধীনভাবে এসব কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

কুয়েতের পাবলিক অথরিটি ফর ম্যানপাওয়ার (PAM) কর্তৃক জারি করা এই নতুন নিয়মটি দেশটির শ্রমবাজারকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, যেখানে স্থানীয় নাগরিকদের কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

নতুন আইনটি আসলে কী? এই নতুন আইনের মূল কথা হলো, নির্দিষ্ট ১২০টি পেশায় এখন থেকে আর কোনো প্রবাসী বা বিদেশি নাগরিক ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। পূর্বে, কুয়েতে বসবাসরত অনেক প্রবাসী, বিশেষ করে যারা ফ্যামিলি ভিসা বা Dependent Visa (আর্টিকেল ২২)-এর অধীনে ছিলেন, তারা তাদের দক্ষতা ব্যবহার করে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্স প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পেতেন। নতুন এই নিয়মের ফলে সেই পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।

এখন থেকে কুয়েতে যেকোনো ধরনের কাজ করতে হলে একজন নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা বা স্পনসর (কফিল)-এর অধীনে থেকে তার কোম্পানির জন্যই কাজ করতে হবে। ‘সাইড হাসল’ বা মূল চাকরির বাইরে অতিরিক্ত আয়ের জন্য অন্য কোনো প্রকল্পে কাজ করা আর বৈধ থাকবে না।

কোন কোন পেশা পড়ছে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায়? যদিও সম্পূর্ণ ১২০টি পেশার তালিকা এখনও বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়নি, তবে স্থানীয় আরব গণমাধ্যমগুলোর সূত্রে যে প্রধান খাতগুলোর কথা উঠে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে:

তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবা (IT & Digital Services):

👉 ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও প্রোগ্রামিং 

👉 গ্রাফিক ডিজাইন 

👉 ডিজিটাল মার্কেটিং এবং এসইও (SEO) 

👉 মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট 

👉 সাইবার সিকিউরিটি কনসালটেন্সি

 কনটেন্ট ও মিডিয়া (Content & Media):

                    👉 কনটেন্ট রাইটিং এবং ব্লগিং

                    👉 অনুবাদ সেবা

                    👉 ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি

                    👉 ভিডিও এডিটিং

পরামর্শ সেবা (Consultancy Services):
                    👉 ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শ
                    👉 মার্কেটিং ও জনসংযোগ কনসালটেন্সি
                    👉 আইটি কনসালটেন্সি
                    👉 মানবসম্পদ (HR) পরামর্শ

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (Education & Training):
প্রাইভেট টিউটরিং এবং অনলাইন কোচিং
কারিগরি প্রশিক্ষণ

এই তালিকা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, মূলত জ্ঞান-ভিত্তিক এবং দক্ষ পেশাগুলোকেই এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে, যেগুলোতে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী অত্যন্ত সফলভাবে কাজ করছিলেন।

কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত? সরকারের লক্ষ্য কী? কুয়েত সরকারের এই পদক্ষেপের পেছনে বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে, যা তাদের ‘নতুন কুয়েত ২০৩৫’ ভিশনের অংশ।

১. কুয়েতীকরণ (Kuwaitization): সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো দেশের কর্মক্ষেত্রে কুয়েতি নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। অনেক শিক্ষিত ও দক্ষ কুয়েতি তরুণ-তরুণী এখন কর্মবাজারে প্রবেশ করছেন, এবং সরকার চায়, প্রবাসীদের দ্বারা পরিচালিত এই লাভজনক ফ্রিল্যান্স খাতটি তাদের দখলে আসুক। ২. বেকারত্ব হ্রাস: স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার কমাতে এবং তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ৩. শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ: সরকার দেশের শ্রমবাজারকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অবৈধ বা অনথিভুক্ত ‘ছায়া অর্থনীতি’ (Shadow Economy) বন্ধ করা এবং সকল কর্মীকে একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর অধীনে আনাই এর উদ্দেশ্য। ৪. অর্থের বহিঃপ্রবাহ রোধ: প্রবাসীরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করেন, তার একটি বড় অংশ নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন। এই খাতটি কুয়েতিদের জন্য সংরক্ষিত হলে উপার্জিত অর্থ দেশের অর্থনীতিতেই আবর্তিত হবে বলে সরকার মনে করছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপর কী প্রভাব পড়বে? এই সিদ্ধান্তটি কুয়েতে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির উপর, বিশেষ করে দক্ষ পেশাজীবীদের উপর, মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

            আয়ের উৎস বন্ধ: অনেক বাংলাদেশি আইটি বিশেষজ্ঞ, ডিজাইনার, লেখক এবং মার্কেটার তাদের মূল চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে অতিরিক্ত আয় করতেন। এই আইন তাদের আয়ের একটি বড় উৎস বন্ধ করে দেবে।

            ফ্যামিলি ভিসায় থাকাদের সংকট: সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেসব প্রবাসীরা, যারা তাদের স্বামী/স্ত্রী বা পিতামাতার স্পনসরশিপে ফ্যামিলি ভিসায় কুয়েতে বসবাস করছিলেন। তাদের অনেকেই নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে সংসারে অবদান রাখতেন বা নিজের কর্মজীবন সচল রেখেছিলেন। এখন তাদের জন্য বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ প্রায় থাকবে না।

            ক্যারিয়ার গঠনে বাধা: অনেক তরুণ বাংলাদেশি প্রবাসীর জন্য ফ্রিল্যান্সিং ছিল তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ক্যারিয়ার গড়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। এই পথ বন্ধ হওয়ায় তাদের পেশাগত উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে।

            দেশত্যাগের ভাবনা: যে সকল উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীর জন্য ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগটি কুয়েতে থাকার একটি বড় আকর্ষণ ছিল, তারা এখন বিকল্প হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা অন্যান্য দেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন, যেখানে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কাজের পরিবেশ অনেক বেশি অনুকূল।

ভবিষ্যৎ কী এবং করণীয়? এই আইন প্রমাণ করে যে, কুয়েতের শ্রমবাজার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সরকারের বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট: দেশটি এখন সাধারণ কর্মীর পরিবর্তে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন এবং বিশেষায়িত পেশাজীবীদের খুঁজছে, এবং যেসব ক্ষেত্রে স্থানীয়রা কাজ করতে সক্ষম, সেসব খাত ক্রমান্বয়ে প্রবাসীদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসবে।

এমন পরিস্থিতিতে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নতুন বাস্তবতার সাথে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া। এখন করণীয় হতে পারে:

        👉 একটিমাত্র স্পনসরের অধীনে স্থিতিশীল এবং পূর্ণকালীন চাকরিতে মনোনিবেশ করা।

        👉 নিজেকে আরও দক্ষ করে তোলা এবং এমন বিশেষায়িত ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নেওয়া, যেখানে স্থানীয় কর্মীর অভাব রয়েছে।

        👉 কোনো অবস্থাতেই অবৈধভাবে বা লুকিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের চেষ্টা না করা, কারণ ধরা পড়লে তার পরিণতি হবে জরিমানা এবং চূড়ান্তভাবে দেশে ফেরত পাঠানো।

উপসংহার: কুয়েত সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রবাসী সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় ধাক্কা। এটি skilled expatriates দের জন্য দেশটিতে কাজ করার নিয়মকানুন এবং সুযোগকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দেবে। এই নতুন এবং কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, আইনানুগ পথে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার মধ্যেই এখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ নিহিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!