বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, শত শত বছর ধরে এই দেশের মানুষ নদীর সঙ্গে মিশে আছে। নৌকা শুধু পরিবহনের মাধ্যমই নয়, মানুষের সংস্কৃতি ও বিনোদনের অংশও। নৌকা বাইচ তাই গ্রামীণ জীবনে এক অনন্য উৎসবের রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর বর্ষার শেষে কিংবা শারদীয় উৎসবে দেশের নানা প্রান্তে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়, যা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই খেলা কি শুধু লোকজ ঐতিহ্যের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে? আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোয়িং বা ড্রাগন বোট রেসিং যখন অলিম্পিক বা বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে, তখন কেন বাংলাদেশের নৌকা বাইচ এখনও বিশ্ব দরবারে পৌঁছাতে পারেনি? এটা কি কেবল সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা, নাকি এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনা?
নৌকা বাইচের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
নৌকা বাইচের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।
👉 এটি মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজে অবসর ও আনন্দের মাধ্যম হিসেবে গড়ে ওঠে।
👉 গ্রামীণ মানুষ একত্রিত হয়ে বড় নৌকা বানায়, নাম দেয় “পদ্মা বাহিনী” বা “সোনার তরী” ইত্যাদি।
👉 প্রতিযোগিতা মানে শুধু জয়-পরাজয় নয়, বরং সামগ্রিক উৎসব। মেলায় থাকে পিঠা, গান, নাটক—সবকিছু মিলিয়ে এক ধরনের সামাজিক মিলনমেলা, এই ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে মূল্যবান।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—শুধু লোকজ ঐতিহ্যের ভেতরে আটকে থেকে কি আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাব?
আন্তর্জাতিক ক্রীড়ার সাথে তুলনা
বিশ্বে নৌকা বাইচের মতো অনেক খেলা রয়েছে যেগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
রোয়িং (Rowing):
👉 সুনির্দিষ্ট নিয়ম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও পেশাদার অ্যাথলেট রয়েছে।
👉 এটি অলিম্পিক গেমসে অন্তর্ভুক্ত।
ড্রাগন বোট রেসিং:
👉 চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জনপ্রিয়।
👉 আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও ফেডারেশন রয়েছে।
কায়াকিং ও ক্যানোয়িং:
👉 ইউরোপ ও আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়।
👉 বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হয় নিয়মিত।
বাংলাদেশের নৌকা বাইচ:
👉 এর কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই।
👉 কোনো প্রশিক্ষণ কাঠামো নেই।
👉 আয়োজন হয় মূলত স্থানীয় মেলা বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়।
এখানেই মূল পার্থক্য।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ফাঁপা গৌরব
অনেকের মতেই, বর্তমানে নৌকা বাইচ অনেকাংশে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়।
👉 প্রতিযোগিতা আয়োজনের পেছনে থাকে স্থানীয় নেতাদের প্রচারণা।
👉 পুরস্কার হিসেবে ফ্রিজ, টিভি বা মোটরসাইকেল দেওয়া হয়—যা অনেক সময় রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার।
👉 তরুণদের কর্মসংস্থানের বিকল্প না দিয়ে কেবল উৎসবে ব্যস্ত রাখা হয়।
ফলে খেলার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যাচ্ছে। এটি জাতীয় পর্যায়ে সংগঠিত হওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় ‘শো’তে পরিণত হচ্ছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
ইতিবাচক দিক:
-
গ্রামীণ জনগণ আনন্দ পায়, উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
-
স্থানীয় অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হয় (মেলা, ব্যবসা, খাবার ইত্যাদি)।
নেতিবাচক দিক:
-
তরুণরা পেশাদার খেলার সুযোগ না পেয়ে সময় নষ্ট করে।
-
দীর্ঘমেয়াদে এর কোনো অর্থনৈতিক অবদান নেই।
-
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি না পাওয়ায় সম্ভাবনা অপচয় হয়।
কেন আন্তর্জাতিক সাফল্য আসছে না?
-
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব — নৌকা বাইচের কোনো জাতীয় ফেডারেশন নেই।
-
স্ট্যান্ডার্ডাইজড নিয়ম নেই — আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নিয়ম তৈরি হয়নি।
-
গবেষণা ও বিনিয়োগের অভাব — আধুনিক রোয়িং বা ড্রাগন বোটের মতো নৌকা তৈরি করা হয়নি।
-
রাজনৈতিক দখলদারিত্ব — স্থানীয় নেতাদের হাতে এই খেলা বন্দি হয়ে গেছে।
সম্ভাবনা—যদি আমরা চাই
বাংলাদেশ চাইলে নৌকা বাইচকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে পারত।
-
জাতীয় নৌকা বাইচ ফেডারেশন গঠন: আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগিতা আয়োজন করা।
-
প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো: খেলোয়াড়দের জন্য রোয়িং একাডেমি গড়ে তোলা।
-
আন্তর্জাতিক সংযোগ: দক্ষিণ এশিয়া গেমসে নৌকা বাইচ অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা।
-
পর্যটন খাত: নৌকা বাইচকে পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে গড়ে তোলা।
বাস্তবতা বনাম কল্পনা
আমাদের নৌকা বাইচ আন্তর্জাতিক খেলা হতে পারত, কিন্তু হয়নি। কারণ—
👉 নেতাদের স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্নতা,
👉 পরিকল্পনার অভাব,
👉 তরুণদের যথাযথ দিকনির্দেশনা না দেওয়া।
তাই এখন এটি কেবল "টাইম পাস" খেলা হয়ে গেছে।
ভবিষ্যৎ করণীয়
-
সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে নৌকা বাইচে পরিকল্পনা নিতে হবে।
-
বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।
-
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে প্রতিযোগিতা চালু করা যেতে পারে।
-
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশের নৌকা বাইচ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। তবে এটিকে যদি কেবল রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা বা বেকার তরুণদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কখনো আসবে না। আমাদের নেতাদের দেওয়া মোটরসাইকেল বা ফ্রিজ সাময়িক গৌরব দিতে পারে, কিন্তু একটি খেলার আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেয় না। যদি আমরা সত্যিই চাই, তবে পরিকল্পিত বিনিয়োগ, কাঠামোবদ্ধ আয়োজন এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের মাধ্যমে নৌকা বাইচকে বৈশ্বিক ক্রীড়ামঞ্চে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। অন্যথায় এটি কেবল একটি মৌসুমি উৎসব হিসেবেই রয়ে যাবে।
