প্রবাস জীবনটা অনেকটা নদীর মতো। সপ্তাহের পাঁচ দিন, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার, সেই নদীটা অফিসের রুটিন আর কাজের চাপে খরস্রোতা হয়ে বয়ে চলে। কিন্তু শুক্রবার এলেই নদীটা যেন মোহনায় এসে শান্ত হয়। গতি কমে আসে, তৈরি হয় কিছু স্থির মুহূর্ত, কিছু স্মৃতি। কুয়েতের বুকে একজন সাধারণ প্রবাসীর শুক্রবারটা কেমন কাটে? এটা কোনো একক গল্প নয়, এটা অনেকগুলো ছোট ছোট খণ্ডচিত্রের সমষ্টি। চলুন, আজ সেই ডায়েরির পাতাগুলোই উল্টে দেখা যাক।
খণ্ডচিত্র ১: ভোরের নীরবতা এবং প্রার্থনার সুর (সকাল ৬:০০)
বৃহস্পতিবার রাতটা আমাদের কাছে ঈদের চাঁদের মতো। সপ্তাহের ক্লান্তি শেষে একটু দেরিতে ঘুমানোর বিলাসিতা। তাই শুক্রবারের সকালটা শুরু হয় একটু দেরিতে, আযানের সুমধুর সুরে। এই সকালের নীরবতা টা অন্যরকম। রাস্তায় গাড়ির হর্ন নেই, কনস্ট্রাকশন সাইটের বিরক্তিকর শব্দ নেই। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা হাতে নিলে ভোরের নরম আলোয় দূরের মসজিদগুলোর মিনারগুলোকে ছবির মতো মনে হয়; এই সময়টা একান্তই নিজের। দেশের কথা ভাবা, পরিবারের কথা ভাবা, আর ফেলে আসা দিনগুলোকে মনে করার সময়।
এরপর গোসল সেরে, পরিষ্কার পাঞ্জাবি পরে কাছের মসজিদে জুমার নামাজের জন্য হেঁটে যাওয়া। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তখন দেখা যায় আমার মতো আরও শত শত প্রবাসী—বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, মিশরীয়—সবার গন্তব্য এক। মসজিদের ভেতরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যখন আমরা প্রার্থনায় দাঁড়াই, তখন সব দেশের সীমানা যেন মুছে যায়। এখানে আমরা সবাই এক পরিচয়—আল্লাহর বান্দা। খুতবায় আরবি বয়ান হয়তো পুরোপুরি বুঝি না, কিন্তু এর সুরের মধ্যে যে প্রশান্তি আছে, তা পুরো সপ্তাহের ক্লান্তি দূর করে দেয়। নামাজ শেষে একে অপরের সাথে কুশল বিনিময়, এক চিলতে হাসি—এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই প্রবাসের একাকীত্বকে কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দেয়।
খণ্ডচিত্র ২: মধ্যাহ্নের ভোজ এবং ভাতঘুমের আবেশ (দুপুর ১:৩০)
শুক্রবার মানেই হলো আমাদের 'ব্যাচেলর মেস'-এর জন্য এক উৎসবের দিন। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে কোনোমতে ডাল-ভাত বা রুটি-সবজি দিয়ে চালিয়ে দিলেও, এই দিনটার জন্য বরাদ্দ থাকে বিশেষ আয়োজন। মাস শেষে পাওয়া বেতনের টাকা থেকে চাঁদা তুলে বাজার করা হয়। মেন্যুতে থাকে সাধারণত গরুর মাংস ভুনা, বড় মাছের দোপেঁয়াজা, আর সাথে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত।
রান্নার দায়িত্বটা ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। কেউ পেঁয়াজ কাটে, কেউ মশলা বাটে, আর কেউবা রান্নার মূল কারিগর। রান্নাঘরে তখন চলে হাসি-ঠাট্টা, দেশের গল্প আর একে অপরকে নিয়ে খুনসুটি। এই সময়টায় মনে হয় না আমরা বাড়ি থেকে হাজার মাইল দূরে আছি; মনে হয়, আমরা যেন একান্নবর্তী পরিবারেরই একটা অংশ।
একসাথে বসে গরম ভাতের সাথে ঝাল ঝাল মাংস ভুনা খাওয়ার যে তৃপ্তি, তা সম্ভবত পৃথিবীর কোনো দামী রেস্তোরাঁয় পাওয়া সম্ভব নয়। ভরপেট খাওয়ার পর যে ভাতঘুমটা আসে, তা যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এসি'র শীতল বাতাসে, সব চিন্তা ভুলে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া—এই বিলাসিতাটুকু পাওয়ার জন্যই হয়তো আমরা সপ্তাহের বাকি পাঁচটা দিন এত কঠোর পরিশ্রম করি।
খণ্ডচিত্র ৩: বিকেলের ক্রিকেট এবং বন্ধুত্বের উল্লাস (বিকাল ৪:৩০)
ঘুম ভাঙতেই শরীরে নতুন করে শক্তি ফিরে আসে। বিকেলের নরম আলোয় কুয়েতের অনেক খোলা মাঠ বা পার্ক, যেগুলো স্থানীয়ভাবে 'হাদিকা' নামে পরিচিত, সেগুলো হয়ে ওঠে এক একটি মিনি-স্টেডিয়াম। ধুলোমাখা মাঠে পুরোনো টেনিস বল আর ব্যাট নিয়ে যখন আমরা ক্রিকেটে মেতে উঠি, তখন বয়সটা যেন দশ বছর কমে যায়।
এখানে কোনো পেশাদার খেলোয়াড় নেই, নেই কোনো কঠিন নিয়মকানুন। কেউ হয়তো খালি পায়ে দৌড়াচ্ছে, কেউবা স্যান্ডেল পরেই বল করছে। কিন্তু উত্তেজনা আর আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। প্রতিটি চারের মার বা প্রতিটি উইকেটের পতনে যে উল্লাসটা হয়, তা যেকোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। খেলার সূত্রে পরিচয় হয় নতুন নতুন মানুষের সাথে। এখানে কে কোন কোম্পানির বড় ম্যানেজার আর কে সাধারণ শ্রমিক—সেই ভেদাভেদ থাকে না। সবার পরিচয় এক—আমরা ক্রিকেটার, আমরা প্রবাসী বন্ধু। এই খেলাটা কেবল বিনোদনই দেয় না, এটি আমাদের মধ্যে এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেয়।
খণ্ডচিত্র ৪: সন্ধ্যার বাজার এবং দেশের স্বাদ খোঁজা (সন্ধ্যা ৭:০০)
ক্রিকেটের ক্লান্তি শেষে শরীরটা যখন একটু বিশ্রাম চায়, তখন শুরু হয় আগামী সপ্তাহের প্রস্তুতি। দলবেঁধে যাওয়া হয় ফারওয়ানিয়া বা জিলিবের কোনো এক বাংলাদেশি সুপারমার্কেটে। এই দোকানগুলো কুয়েতের বুকে এক একটি ছোট বাংলাদেশ। ভেতরে ঢুকলেই নাকে আসে পরিচিত মশলার গন্ধ, তাকগুলোতে সাজানো থাকে প্রাণ-এর চানাচুর, রাঁধুনীর মশলা, আর তাজা পুঁইশাক-ডাঁটাশাক।
এখানে বাজার করাটা কেবল কেনাকাটা নয়, এটা অনেকটা দেশের সাথে সংযোগ স্থাপনের মতো। এখানে এসে আমরা করলা বা পটলের মতো 'দুর্লভ' সবজি খুঁজে বেড়াই, দেশের মতো করে ইলিশ মাছের দামাদামি করি, আর পরিচিত ব্র্যান্ডের পণ্য কিনে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি লাভ করি। বাজারের কোলাহল, বিক্রেতাদের হাঁকডাক, আর চারপাশের বাংলা কথোপকথন—সবকিছু মিলে মনে হয় যেন ঢাকার কোনো কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে আছি। এই অনুভূতিটা আমাদের শেকড়ের টানকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়।
খণ্ডচিত্র ৫: রাতের ভিডিও কল এবং এক বুক শূন্যতা (রাত ১০:০০)
দিনের সব কোলাহল শেষে, যখন রুমে ফিরে একা হই, তখন শুরু হয় শুক্রবারের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তটি। হাতে স্মার্টফোন, স্ক্রিনের ওপারে ভেসে ওঠে প্রিয়জনের মুখ—বাবা-মা, স্ত্রী, বা সন্তানের মায়াবী মুখ। ভিডিও কলে তাদের সাথে কথা বলা, তাদের হাসি দেখা, সারাদিনের গল্প শোনা—এটাই আমাদের সপ্তাহের সেরা প্রাপ্তি।
আমরা তাদের দেখাই, আমরা ভালো আছি, ভালো খাচ্ছি। আমরা হাসি-খুশি থাকার অভিনয় করি, যাতে তারা চিন্তা না করে। কিন্তু কলের শেষে, যখন স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে যায়, তখন এক তীব্র শূন্যতা এসে গ্রাস করে। এই হাসির আড়ালে যে কতটা কষ্ট, কতটা একাকীত্ব লুকিয়ে থাকে, তা কেবল আরেকজন প্রবাসীই বুঝতে পারে। এই ডিজিটাল সংযোগ আমাদের কাছে এনেছে ঠিকই, কিন্তু স্পর্শের উষ্ণতাটুকু দিতে পারেনি। এই শূন্যতাটুকু বুকে নিয়েই আমরা আবার আরেকটি সপ্তাহের জন্য প্রস্তুতি নিই।
এই ছোট ছোট আনন্দ, বেদনা, বন্ধুত্ব আর স্মৃতির কোলাজ দিয়েই তৈরি হয় কুয়েতের বুকে এক প্রবাসীর শুক্রবার। এটি কেবল একটি ছুটির দিন নয়, এটি আমাদের রিচার্জ হওয়ার দিন, আমাদের নিজেদের খুঁজে পাওয়ার দিন, এবং নতুন করে স্বপ্ন দেখার দিন।