একসময় মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েত ছিল লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশির জন্য এক স্বপ্নের নাম, এক ‘সোনার হরিণ’। সত্তর-আশির দশক থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা সময়ের সাথে সাথে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়। এদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যেমনি কুয়েতের প্রয়োজন ছিল প্রবাসী কর্মীদের, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজন ছিল তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই পারস্পরিক প্রয়োজনের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল এক মজবুত সম্পর্ক। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই সোনালী দিনগুলো আজ অনেকটাই ফ্যাকাশে। যে কুয়েত একসময় ছিল সকল সুযোগ এর এক উর্বর ক্ষেত্র, আজ সেই কুয়েতের শ্রমবাজারে বইছে এক হিমশীতল মন্দার হাওয়া।
চাকরিচ্যুতি, নতুন নিয়োগে স্থবিরতা, ভিসা পরিবর্তনে কঠোরতা এবং প্রতিনিয়ত কানুন পরিবর্তন—এইসব মিলিয়ে কুয়েতে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এটি কোনো সাময়িক সংকট নয়, বরং এক কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যার পেছনে রয়েছে বহুমুখী কারণ এবং যার পরিণতি হতে পারে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এই প্রতিবেদনে আমরা কুয়েতের শ্রমবাজারের এই মন্দার পেছনের কারণগুলো ব্যবচ্ছেদ করব এবং এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের টিকে থাকার কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
বর্তমান পরিস্থিতি - একটি কঠিন বাস্তবতা
কুয়েতের চাকরির বাজারের বর্তমান অবস্থাকে এককথায় ‘সংকুচিত’ বলা চলে। যে লক্ষণগুলো এই মন্দাকে সুস্পষ্ট করে তুলেছে, সেগুলো হলো:
ব্যাপকহারে চাকরিচ্যুতি ও কর্মী ছাঁটাই: অর্থনৈতিক চাপ এবং সরকারি নীতির কারণে বহু বেসরকারি কোম্পানি তাদের কর্মী সংখ্যা কমিয়ে আনছে। বিশেষ করে কনস্ট্রাকশন, রিটেইল এবং বিভিন্ন সেবাখাতে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অনেক কোম্পানি নতুন প্রকল্প হাতে নিতে পারছে না, ফলে পুরনো কর্মীদেরও ধরে রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
নতুন নিয়োগে স্থবিরতা: বাজারে নতুন চাকরির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। একসময় যেখানে একজন দক্ষ কর্মীর হাতে একাধিক চাকরির অফার থাকতো, আজ সেখানে একটি চাকরি পেতেই महीनों, এমনকি বছরও লেগে যাচ্ছে। বিভিন্ন অনলাইন জব পোর্টাল এবং স্থানীয় পত্রিকার শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের সংখ্যা দেখলেই এই স্থবিরতার চিত্র স্পষ্ট বোঝা যায়।
ভিসা ট্রান্সফারে (আকামা পরিবর্তন) নজিরবিহীন কঠোরতা: কুয়েতের শ্রমবাজারের একটি বড় সুবিধা ছিল এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ। কিন্তু বর্তমানে এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কঠিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু পেশা ছাড়া ভিসা ট্রান্সফার বন্ধ থাকায়, কর্মীরা চাকরি হারালে বা বর্তমান চাকরিতে সন্তুষ্ট না থাকলেও অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এর ফলে এক ধরনের জিম্মি দশার সৃষ্টি হয়েছে।
বেতন স্থবিরতা এবং সুযোগ-সুবিধা হ্রাস: নতুন চাকরিতে বেতন যেমন বাড়ছে না, তেমনি পুরনো কর্মীদেরও বেতন বৃদ্ধির হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। অনেক কোম্পানি আবার খরচ কমানোর অজুহাতে কর্মীদের ওভারটাইম এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও কমিয়ে দিচ্ছে, যা প্রবাসীদের জীবনযাত্রার মানের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
এই সম্মিলিত পরিস্থিতি প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের নীরব হতাশা এবং আতঙ্ক তৈরি করেছে। কবে কার চাকরি চলে যায়, বা আকামার মেয়াদ শেষ হলে তা আর নবায়ন হবে কিনা—এই দুশ্চিন্তা এখন প্রায় প্রতিটি প্রবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী।
মন্দার নেপথ্যে - বহুমুখী কারণের বিশ্লেষণ
কুয়েতের শ্রমবাজারের এই মন্দার পেছনে কোনো একক কারণ দায়ী নয়, বরং এটি বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় নীতি, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের সম্মিলিত ফল।
১. কুয়েতকরণ নীতি (Kuwaitization) - সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার: এই সংকটের সবচেয়ে বড় এবং মূল চালিকাশক্তি হলো কুয়েত সরকারের ‘কুয়েতীকরণ’ নীতি। এটি তাদের ‘নতুন কুয়েত ২০৩৫’ ভিশনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যার মূল লক্ষ্য হলো দেশের অর্থনীতিকে প্রবাস-নির্ভরতা থেকে বের করে এনে স্থানীয় নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত করা। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে:
সরকারি চাকরিতে শতভাগ সংরক্ষণ: কুয়েতের সরকারি খাতের প্রায় সকল চাকরি এখন শুধুমাত্র কুয়েতি নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত। পূর্বে যে সকল প্রশাসনিক পদে প্রবাসীরা কাজ করতেন, সেখান থেকে তাদের পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বেসরকারি খাতে কোটা নির্ধারণ: বেসরকারি কোম্পানিগুলোর উপরও এখন কুয়েতি কর্মী নিয়োগের জন্য কঠোর কোটা আরোপ করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সংখ্যক কুয়েতি নিয়োগ না দিলে সেই কোম্পানির নতুন ভিসা ইস্যু করা বা পুরনো ভিসা নবায়ন করা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
পেশাভিত্তিক সংরক্ষণ: নির্দিষ্ট কিছু পেশা, যেমন—আইটি, মানবসম্পদ, প্রশাসনিক এবং সেক্রেটারিয়াল পদ—শুধুমাত্র কুয়েতিদের জন্য সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া চলছে, যা দক্ষ প্রবাসীদের জন্য একটি বড় হুমকি।
২. অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বৈশ্বিক প্রভাব: করোনা মহামারী পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব কুয়েতের অর্থনীতিতেও পড়েছে। দেশটির আয়ের প্রধান উৎস তেলের দামের অস্থিতিশীলতা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে প্রভাবিত করেছে। অনেক কোম্পানি নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের উপর। অর্থনৈতিক এই অনিশ্চয়তার কারণে কোম্পানিগুলো এখন ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতি গ্রহণ করছে, যা প্রবাসী কর্মীদের জন্য এক বিরাট ঝুঁকি।
৩. শ্রমবাজারের কাঠামোগত পরিবর্তন - অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস: কুয়েত এখন আর আগের মতো সাধারণ নির্মাণ শ্রমিক বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। দেশটি প্রযুক্তি-ভিত্তিক এবং জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছে। ফলে, বাজারে এখন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীর চাহিদা বাড়ছে। যেমন:
বিশেষায়িত প্রকৌশলী (সিভিল, মেকানিক্যাল, পেট্রোলিয়াম)
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ (সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা এনালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার)
চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী
উচ্চ প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল সংখ্যক কর্মী কুয়েতে যান, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ বা আধা-দক্ষ। এই ‘স্কিল গ্যাপ’ বা দক্ষতার অভাবের কারণে আমাদের কর্মীরা নতুন এবং ভালো বেতনের চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছেন না।
৪. ভিসা বাণিজ্য এবং অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান: ‘ফ্রি ভিসা’ নামক অবৈধ ভিসা বাণিজ্য কুয়েতের শ্রমবাজারকে বরাবরই অস্থিতিশীল করে রেখেছে। কুয়েত সরকার সম্প্রতি এই অবৈধ ভিসা ব্যবসায়ী এবং আকামাবিহীন কর্মীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ প্রবাসীদের গ্রেপ্তার এবং নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এই কঠোর অভিযানের ফলে শ্রমবাজারে এক ধরনের ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং এটি সামগ্রিকভাবে প্রবাসীদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও পরিণতি
শ্রমবাজারের এই মন্দা কেবল কিছু মানুষের চাকরি হারানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর এবং সুদূরপ্রসারী।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে: হাজার হাজার প্রবাসী তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে এসে আজ হতাশায় নিমজ্জিত। চাকরি হারিয়ে বা কম বেতনে কাজ করে অনেকেই দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না, ফলে দেশে থাকা তাদের পরিবারগুলোও আর্থিক সংকটে পড়ছে। অভিবাসনের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব: কুয়েত বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের একটি অন্যতম বড় উৎস। শ্রমবাজারের মন্দা এবং নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে এই রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিমধ্যেই ভাটা পড়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কুয়েতের উপর প্রভাব: একদিকে কুয়েত সরকার যদিও ‘কুয়েতীকরণ’ বাস্তবায়ন করতে চাইছে, অন্যদিকে অনেক খাত রয়েছে যেখানে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত এবং ইচ্ছুক কুয়েতি নাগরিক পাওয়া কঠিন। এর ফলে, দক্ষ প্রবাসী কর্মীদের বিদায়ে বিভিন্ন সেবাখাতে এক ধরনের শূন্যতা বা ‘লেবার শর্টেজ’ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা তাদের নিজেদের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কী? টিকে থাকার কৌশল ও করণীয়
এই পরিবর্তিত এবং কঠিন বাস্তবতায় কুয়েতে টিকে থাকতে হলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রচলিত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
দক্ষতা বৃদ্ধিই একমাত্র পথ: একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়—কুয়েতে অদক্ষ কর্মীর যুগ প্রায় শেষের পথে। টিকে থাকতে হলে দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। যে যে খাতের চাহিদা রয়েছে, যেমন—আইটি, নার্সিং, বিভিন্ন টেকনিক্যাল ট্রেড (ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রিক্যাল), ভারী যানবাহন চালানো—সেই সব বিষয়ে বাংলাদেশ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে আসাটা হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
আইন মেনে চলা: যেকোনো পরিস্থিতিতে কুয়েতের আইন মেনে চলতে হবে। বৈধ আকামা এবং নিজের স্পনসরের অধীনে কাজ করা এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি জরুরি। ‘ফ্রি ভিসা’র ধারণা মাথা থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে হবে।
পেশাদারিত্ব এবং নেটওয়ার্কিং: কর্মক্ষেত্রে নিজের সেরাটা দিয়ে পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। একই সাথে, নিজ পেশার মানুষদের সাথে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা নতুন চাকরির সুযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা: বাংলাদেশ সরকারের উচিত, কুয়েতের শ্রমবাজারের নতুন চাহিদা অনুধাবন করে দেশে দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য আরও বেশি বিনিয়োগ করা। একই সাথে, উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন কোটা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালানো।
উপসংহার: কুয়েতের শ্রমবাজারের ‘সোনার হরিণ’-এর যুগ হয়তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সম্ভাবনার দুয়ার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে, এই দুয়ার এখন শুধুমাত্র তাদের জন্যই খোলা, যারা দক্ষ, পেশাদার এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে প্রস্তুত। এটি এখন আর সহজ অভিবাসনের ঠিকানা নয়, বরং এক তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। যে সকল প্রবাসী বাংলাদেশি এই নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নিজেদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন, শুধুমাত্র তারাই এই কঠিন সময়ে টিকে থেকে নিজেদের এবং দেশের জন্য অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।