স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ: নগদবিহীন অর্থনীতির পথে কতটা এগিয়েছে দেশ?

0



ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর: ঢাকার একটি ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে, একজন ডাব বিক্রেতা তার দোকানের সামনে একটি ছোট কিউআর (QR) কোডের স্ট্যান্ড ঝুলিয়ে রেখেছেন। ক্রেতারা ডাব কিনে তাদের স্মার্টফোন দিয়ে সেই কোডটি স্ক্যান করে মুহূর্তের মধ্যেই বিল পরিশোধ করে দিচ্ছেন। কোনো নগদ টাকার লেনদেন নেই, ভাংতি টাকার ঝামেলা নেই। এই ছোট দৃশ্যটিই হয়তো 'স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১'-এর অধীনে একটি 'ক্যাশলেস' বা নগদবিহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নের সবচেয়ে বড় এবং বাস্তবসম্মত প্রতিচ্ছবি।

সরকারের লক্ষ্য হলো, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত করা, যার একটি অন্যতম প্রধান ভিত্তি হবে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল অর্থনীতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে দেশে এখনও একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং পরিষেবার বাইরে এবং যেখানে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিই প্রধান চালিকাশক্তি, সেখানে এই নগদবিহীন সমাজের স্বপ্ন কতটা বাস্তবসম্মত? এবং এই স্বপ্ন পূরণের পথে আমাদের অর্জন এবং চ্যালেঞ্জগুলোই বা কী?

বিপ্লবের ভিত্তি: মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS)

বাংলাদেশে নগদবিহীন অর্থনীতির বিপ্লবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস বা MFS। এক দশক আগেও, দেশের অধিকাংশ মানুষের, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর, কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। কিন্তু মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রসারের উপর ভিত্তি করে, বিকাশ, রকেট এবং নগদের মতো MFS প্ল্যাটফর্মগুলো দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।

  • প্রভাব: আজ, একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে একজন গার্মেন্টস কর্মী পর্যন্ত, প্রায় প্রত্যেকেরই একটি MFS অ্যাকাউন্ট আছে। টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, এমনকি সঞ্চয়—এই সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে MFS গ্রাহকের সংখ্যা ১৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে। এটিই ক্যাশলেস সোসাইটির জন্য একটি শক্তিশালী এবং উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

নতুন উদ্যোগ: ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার

MFS-এর সাফল্যের উপর ভিত্তি করে, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডিজিটাল লেনদেনকে আরও সার্বজনীন এবং সহজ করার জন্য একাধিক নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

  • বাংলা কিউআর (Bangla QR): ডাব বিক্রেতার দোকানের সেই QR কোডটিই হলো 'বাংলা কিউআর'-এর উদাহরণ। এটি একটি সর্বজনীন QR কোড ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একজন গ্রাহক তার যেকোনো ব্যাংক বা MFS অ্যাপ ব্যবহার করে অন্য যেকোনো ব্যাংক বা MFS অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারবেন। এর ফলে, প্রতিটি দোকানের জন্য আলাদা আলাদা QR কোডের প্রয়োজন হবে না। সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা দেশে, বিশেষ করে ছোট ছোট দোকানগুলোতে, এই বাংলা কিউআর কোডের প্রসার ঘটানোর জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

  • বিনিময় (Binimoy): এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের চালু করা একটি যুগান্তকারী 'ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল ট্রানজ্যাকশন প্ল্যাটফর্ম' (IDTP)। এর মাধ্যমে, আপনি আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, বা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি আপনার নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারবেন। এটি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার দেয়াল ভেঙে দিয়ে একটি একীভূত ডিজিটাল লেনদেন ইকোসিস্টেম তৈরি করছে।

  • ডিজিটাল ব্যাংক: কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে কোনো শাখা ছাড়াই সম্পূর্ণ অনলাইন-ভিত্তিক 'ডিজিটাল ব্যাংক' স্থাপনের জন্য লাইসেন্স প্রদান করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই ব্যাংকগুলো প্রযুক্তির ব্যবহার করে আরও কম খরচে এবং উদ্ভাবনী সেবা প্রদান করতে পারবে, যা তরুণ প্রজন্মকে ডিজিটাল লেনদেনে আরও বেশি উৎসাহিত করবে।

চ্যালেঞ্জের পাহাড়: যে বাধাগুলো অতিক্রম করতে হবে

স্বপ্নটি যত বড়ই হোক, এর বাস্তবায়নের পথটি মোটেও মসৃণ নয়।

  • ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব: দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এখনও স্মার্টফোন এবং ডিজিটাল লেনদেন ব্যবহারে ততটা স্বচ্ছন্দ নয়। তাদের মধ্যে ডিজিটাল প্রতারণা নিয়ে এক ধরনের ভয় কাজ করে। এই ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাবই ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

  • গ্রামীণ ইন্টারনেট অবকাঠামো: যদিও দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে, গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও স্থিতিশীল এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

  • সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি: ডিজিটাল লেনদেন বাড়ার সাথে সাথে ফিশিং, হ্যাকিং এবং বিভিন্ন ধরনের অনলাইন প্রতারণার ঝুঁকিও বাড়ছে। একটি শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

  • অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি: দেশের অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ এখনও অনানুষ্ঠানিক, যেখানে সমস্ত লেনদেন নগদ টাকায় হয়। এই খাতটিকে ডিজিটাল পেমেন্টের আওতায় আনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।

  • মানসিকতার বাধা: বহু মানুষ, বিশেষ করে বয়স্করা, এখনও নগদ টাকার লেনদেনকেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং সহজ বলে মনে করেন। এই মানসিকতার পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্যাশলেস সোসাইটির সুবিধা অনেক। এটি স্বচ্ছতা বাড়ায়, দুর্নীতি কমায়, এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে। তবে, এই রূপান্তরটি হতে হবে समावेशी। কাউকে পেছনে ফেলে রেখে এটি করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপকহারে ডিজিটাল সাক্ষরতা কার্যক্রম, সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা এবং ব্যবহারকারীদের তথ্যের সুরক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা।

পথের শেষ কোথায়? নগদবিহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা একটি দীর্ঘ এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ এই যাত্রায় নিঃসন্দেহে অনেক দূর এগিয়েছে, যার ভিত্তি হলো MFS বিপ্লব। বাংলা কিউআর, বিনিময় এবং ডিজিটাল ব্যাংকের মতো উদ্যোগগুলো এই যাত্রাকে আরও গতিশীল করছে।

চ্যালেঞ্জগুলো বাস্তব, কিন্তু সম্ভাবনাগুলোও বিশাল। সমন্বিত প্রচেষ্টা, জনসচেতনতা এবং সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি প্রায়-নগদবিহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নটি হয়তো আর অবাস্তব থাকবে না। ঢাকার রাস্তার সেই ডাব বিক্রেতার দোকানের QR কোডটিই হয়তো সেই স্মার্ট বাংলাদেশের ভবিষ্যতের একটি ছোট কিন্তু শক্তিশালী পূর্বাভাস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!