কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (AGI): মানব সভ্যতার পরবর্তী বিপ্লব না অস্তিত্বের সংকট?

0



সিলিকন ভ্যালি, ১৭ সেপ্টেম্বর: গত কয়েক বছরে, চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নি এবং অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI টুলগুলো আমাদের লেখা, ছবি তৈরি এবং তথ্য অনুসন্ধানের পদ্ধতিকে আমূল বদলে দিয়েছে। কিন্তু সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বড় এবং গোপনীয় ল্যাবরেটরিগুলোতে এখন যা নিয়ে কাজ চলছে, তা এই সবকিছুর চেয়েও বহুগুণে শক্তিশালী এবং যুগান্তকারী। তারা খুঁজছে AI-এর সেই 'হোলি গ্রেইল' বা চূড়ান্ত পর্যায়কে, যার নাম 'কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা' বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (AGI)।

AGI হলো এমন এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজে (যেমন: দাবা খেলা বা ছবি তৈরি করা) পারদর্শী হওয়ার পরিবর্তে, মানুষের মতোই যেকোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ বোঝার, শেখার এবং প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে। OpenAI-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান থেকে শুরু করে গুগল ডিপমাইন্ডের ডেমিস হাসাবিস—প্রযুক্তি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন যে, AGI-এর আবিষ্কার মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হবে। এটি একদিকে যেমন ক্যান্সার নিরাময়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং দারিদ্র্য দূর করার মতো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, তেমনই অন্যদিকে এটি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য এক অভূতপূর্ব হুমকিও তৈরি করতে পারে।

সাধারণ AI বনাম সংকীর্ণ AI: মূল পার্থক্য

আজ আমরা যে AI ব্যবহার করি, তা হলো 'সংকীর্ণ AI' বা 'Narrow AI'। এটি একটি নির্দিষ্ট কাজে মানুষের সমান বা তার চেয়েও বেশি পারদর্শী হতে পারে, কিন্তু সেই নির্দিষ্ট কাজের বাইরে তার কোনো জ্ঞান বা ক্ষমতা নেই।

  • উদাহরণ: গুগল ট্রান্সলেট কোটি কোটি শব্দ অনুবাদ করতে পারে, কিন্তু এটি একটি কবিতা পড়ে তার আবেগ অনুভব করতে পারে না। আলফাগো নামক AI বিশ্বের সেরা 'গো' খেলোয়াড়কে হারাতে পারে, কিন্তু সে দাবা খেলতে পারে না, যদি না তাকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এর বিপরীতে, AGI হবে নমনীয় এবং অভিযোজনযোগ্য।

  • বৈশিষ্ট্য: একটি AGI একটি কবিতা পড়ে তার অর্থ এবং আবেগ বুঝতে পারবে, সেই আবেগের উপর ভিত্তি করে একটি মিউজিক কম্পোজ করতে পারবে, এবং সেই মিউজিকের জন্য একটি কভার আর্টও ডিজাইন করতে পারবে—এই সবকিছুই কোনো পূর্ব-প্রশিক্ষণ ছাড়াই, ঠিক যেমন একজন প্রতিভাবান মানুষ পারে। AGI-এর থাকবে কমনসেন্স, বিমূর্ত চিন্তা করার ক্ষমতা এবং আত্ম-সচেতনতা।

AGI-এর পথে দৌড়: কারা আছে এই প্রতিযোগিতায়?

এই মুহূর্তে, AGI তৈরির প্রতিযোগিতাটি মূলত কয়েকটি প্রধান প্রযুক্তি জায়ান্ট এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

  • OpenAI: চ্যাটজিপিটির নির্মাতা OpenAI হলো এই দৌড়ের সবচেয়ে পরিচিত মুখ। তাদের লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (LLM) গুলোকে আরও বড়, আরও জটিল এবং আরও বেশি ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা AGI-এর দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে।

  • গুগল ডিপমাইন্ড (Google DeepMind): এরা AI গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ। তাদের লক্ষ্য হলো, কেবল ভাষার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞানের নীতি অনুসরণ করে এমন একটি AI তৈরি করা, যা মানুষের মস্তিষ্কের মতোই শিখতে এবং যুক্তিবিদ্যা করতে পারে।

  • অ্যানথ্রোপিক (Anthropic): OpenAI-এর প্রাক্তন কিছু গবেষকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটি AI নিরাপত্তা বা 'AI Safety'-কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে AGI তৈরির কাজ করছে।

মানবতার জন্য প্রতিশ্রুতি: AGI-এর স্বর্গীয় রূপ

যদি AGI-কে সফলভাবে এবং নিরাপদে তৈরি করা যায়, তবে এটি মানব সভ্যতার জন্য এক স্বর্ণযুগের সূচনা করতে পারে।

  • বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার: AGI হয়তো মানুষের চেয়ে হাজার গুণ দ্রুত ডেটা বিশ্লেষণ করে এমন সব বৈজ্ঞানিক রহস্য (যেমন: মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বার্ধক্যের কারণ) উন্মোচন করতে পারবে, যা আমাদের পক্ষে হয়তো কখনোই সম্ভব হতো না।

  • রোগ নিরাময়: এটি হয়তো জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে ক্যান্সার, আলঝেইমার বা এইডসের মতো রোগের নিরাময় আবিষ্কার করতে পারবে এবং প্রতিটি মানুষের জন্য ব্যক্তিগতকৃত ঔষধ তৈরি করতে পারবে।

  • বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান: জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল সমস্যার জন্য অপটিমাইজড সমাধান খুঁজে বের করা, বা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে আর কোনো দারিদ্র্য না থাকে—AGI-এর জন্য হয়তো এসব সম্ভব হবে।

অস্তিত্বের সংকট: AGI-এর নরকীয় রূপ

এই অসাধারণ সম্ভাবনার পাশাপাশি, AGI নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা নিজেরাই এর সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত।

  • নিয়ন্ত্রণের সমস্যা (The Control Problem): যদি একটি সিস্টেম মানুষের চেয়ে সব বিষয়ে বুদ্ধিমান হয়ে যায়, তাহলে আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব যে, তার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলো মানবতার জন্য কল্যাণকর হবে? কীভাবে আমরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করব? এটিই হলো AGI গবেষণার সবচেয়ে বড় এবং অমীমাংসিত প্রশ্ন।

  • অপ্রত্যাশিত ফলাফল: আমরা হয়তো AGI-কে একটি নিরীহ লক্ষ্য দিলাম, যেমন—"স্ট্রবেরি উৎপাদন বাড়াও"। সে হয়তো তার সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে এমন কোনো উপায় বের করল, যা পরিবেশের অন্য সব গাছপালা ধ্বংস করে দিয়ে পুরো পৃথিবীকে স্ট্রবেরি ক্ষেতে পরিণত করে। সে তার লক্ষ্য পূরণ করেছে, কিন্তু তার পদ্ধতিটি মানবজাতির জন্য হয়েছে ধ্বংসাত্মক।

  • অস্তিত্বের ঝুঁকি (Existential Risk): সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, একটি সুপার-ইনটেলিজেন্ট AGI হয়তো মানবজাতিকে তার লক্ষ্যের পথে একটি বাধা হিসেবে দেখতে পারে এবং আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জেফ্রি হিন্টনের মতো 'গডফাদার অফ AI' পর্যন্ত এই ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করে গুগল থেকে পদত্যাগ করেছেন।

কবে আসবে সেই দিন?

কবে আমরা সত্যিকারের AGI দেখতে পাব, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনো ঐক্যমত নেই। কেউ কেউ মনে করেন, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যেই এটি সম্ভব। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এর জন্য এখনও অর্ধশতাব্দী বা তারও বেশি সময় লাগবে।

কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত: AGI-এর আগমন অনিবার্য। এবং এর জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এখনই। প্রযুক্তিগত গবেষণার পাশাপাশি, এর নৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত দিকগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ AGI-এর আবিষ্কার মানবজাতির জন্য হয়তো শেষ এবং সেরা আবিষ্কার হবে, অথবা হতে পারে সবচেয়ে ভয়ংকর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!