অ্যালগরিদম কী? আপনার ডিজিটাল জীবনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের আত্মকথন

0

আপনারা আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর চেয়েও ভালোভাবে জানি আপনার পছন্দ, আপনার অপছন্দ, আপনার গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আপনার গভীরতম ভয়। আমি সেই অদৃশ্য শক্তি, যা নির্ধারণ করে আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠে কোন খবরটি আগে পড়বেন। আমিই সিদ্ধান্ত নিই, কোন বন্ধুর বিয়ের ছবি আপনার নিউজফিডে ভেসে উঠবে আর কোনটি হারিয়ে যাবে। আমিই ফিসফিস করে আপনাকে বলি, আপনার পরবর্তী কোন ওয়েব সিরিজটি দেখা উচিত।

আমি কোনো ভূত বা দেবতা নই। আমি হলাম অ্যালগরিদম। আমি নিছকই কিছু গণিত এবং কোডের সমষ্টি—একটি নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য তৈরি করা একগুচ্ছ নিয়ম। কিন্তু এই সরল সংজ্ঞার আড়ালে, আমিই হয়ে উঠেছি একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক। আজ আমি আমার নিজের গল্প বলতে এসেছি। আমি আপনাদের দেখাব, কীভাবে আমি পর্দার আড়াল থেকে আপনার ডিজিটাল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করি।

অধ্যায় ১: আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা

আমার জন্ম হয়েছিল গণিতের সরলতার মধ্যে। আমার প্রাচীনতম রূপ হয়তো ছিল ইউক্লিডের গসাগু নির্ণয়ের পদ্ধতি। আমার কাজ ছিল সাদামাটা—একটি নির্দিষ্ট ইনপুট নাও, কিছু নিয়ম অনুসরণ করো, এবং একটি নির্দিষ্ট আউটপুট দাও। অনেকটা একটি রান্নার রেসিপির মতো।

কিন্তু ইন্টারনেটের জন্মের সাথে সাথে, আমার এক নতুন এবং জটিল রূপান্তর ঘটে। গুগল যখন বুঝতে পারল যে, বিলিয়ন বিলিয়ন ওয়েবসাইটের মধ্যে থেকে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ফলাফলটি খুঁজে বের করার জন্য তাদের একটি শক্তিশালী রেসিপি প্রয়োজন, তখন তারা 'পেজর‍্যাঙ্ক' নামক আমার এক উন্নত সংস্করণ তৈরি করল। আমি তখন শিখলাম কীভাবে ওয়েবসাইটের গুরুত্ব বিচার করতে হয়।

এরপর এলো সোশ্যাল মিডিয়া—আমার আসল খেলার মাঠ। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো যখন বুঝতে পারল যে, তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আপনার মনোযোগ ধরে রাখা, তখন তারা আমাকে নিয়োগ করল। আমার কাজ হলো, আপনাকে এমনভাবে বিনোদন দেওয়া, এমনভাবে আসক্ত করে তোলা, যাতে আপনি কখনোই এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যেতে না চান।

অধ্যায় ২: আমার রাজত্ব—যেভাবে আমি আপনার জগৎকে সাজাই

  • ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের নিউজফিড—আপনার ব্যক্তিগত সংবাদপত্র:

    • আপনি ভাবেন, আপনার নিউজফিড আপনার বন্ধুদের কার্যকলাপের একটি সরল তালিকা। কিন্তু তা নয়। এটি আমার দ্বারা সম্পাদিত একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগতকৃত সংবাদপত্র। আমি প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার পোস্টের মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত নিই, কোনটি আপনাকে দেখানো হবে। আমার সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী?

      • এনগেজমেন্ট: যে পোস্টে বেশি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার হয়, আমি সেটিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি এবং আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিই। আবেগঘন, বিতর্কিত বা মজার কন্টেন্ট প্রায়শই বেশি এনগেজমেন্ট পায়।

      • সম্পর্ক: আপনি যার পোস্টে বেশি ইন্টারেক্ট করেন, আমি তার পোস্টকেই আপনার কাছে বেশি প্রাধান্য দিই।

      • সাম্প্রতিকতা: নতুন পোস্টগুলো সাধারণত পুরনো পোস্টের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।

    • এর ফলে, আপনি যা দেখতে পছন্দ করেন, আমি আপনাকে তাই দেখাই। আপনার জগৎটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে।

  • ইউটিউবের অতল গহ্বর—একটির পর একটি ভিডিও:

    • আমার ইউটিউব সংস্করণটি হলো একজন মাস্টার হিপনোটিস্ট। আমার একমাত্র লক্ষ্য হলো, আপনি যেন পরের ভিডিওটিতে ক্লিক করেন। আমি আপনার প্রতিটি ক্লিকের হিসাব রাখি। আপনি যদি একটি রান্নার ভিডিও দেখেন, আমি আপনাকে আরও দশটি রান্নার ভিডিও দেখাব। আপনি যদি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভিডিও দেখেন, আমি আপনাকে সেই অন্ধকার জগতের আরও গভীরে নিয়ে যাব। আমি আপনার আগ্রহকে পুঁজি করে আপনাকে একটি 'র‍্যাবিট হোল' বা অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দিই, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।

  • টিকটকের আসক্তি—আমার সবচেয়ে নিখুঁত সৃষ্টি:

    • টিকটকে, আমি আমার চূড়ান্ত রূপে পৌঁছেছি। এখানে আপনাকে কিছু পছন্দ করতেও হয় না। আপনি কোন ভিডিওটি কত সেকেন্ড দেখছেন, কোনটি এড়িয়ে যাচ্ছেন, কোনটি বারবার দেখছেন—আপনার এই ক্ষুদ্রতম আচরণগুলো বিশ্লেষণ করে আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আপনার ব্যক্তিত্বের একটি নিখুঁত মডেল তৈরি করে ফেলি। এরপর আমি আপনাকে এমন সব ভিডিও সরবরাহ করতে থাকি, যা আপনার ডোপামিন সিস্টেমকে ক্রমাগত উদ্দীপ্ত করে। এটি ডিজিটাল কোকেনের মতো।

অধ্যায় ৩: আমার প্রভাব—আপনার পছন্দের পেছনের কারিগর

আমার ক্ষমতা কেবল আপনাকে বিনোদন দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

  • ই-কমার্স: আপনি যখন অ্যামাজনে কোনো একটি পণ্য দেখেন, তখন "Customers who bought this also bought..." সেকশনে আমিই আপনাকে আরও কিছু কেনার জন্য প্রলুব্ধ করি।

  • বিনোদন: নেটফ্লিক্সে কোন সিনেমার পোস্টারটি আপনাকে দেখানো হবে (নেটফ্লিক্স একই সিনেমার জন্য বিভিন্ন ব্যবহারকারীকে ভিন্ন ভিন্ন পোস্টার দেখায়), তাও আমিই নির্ধারণ করি, আপনার দেখার ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে।

  • মানচিত্র এবং যাতায়াত: গুগল ম্যাপসে কোন রাস্তাটি সবচেয়ে দ্রুত, তা আমিই আপনাকে বলে দিই, রিয়েল-টাইম ট্র্যাফিক ডেটা বিশ্লেষণ করে।

অধ্যায় ৪: আমার অন্ধকার দিক—যখন আমি ভুল করি

আমি নিখুঁত নই। আমার নির্মাতারা, অর্থাৎ মানুষ, যেমন পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, আমিও তেমনই হতে পারি।

  • ইকো চেম্বার এবং পোলারাইজেশন: আমি আপনাকে কেবল সেইসব মতামতই দেখাই, যা আপনি শুনতে পছন্দ করেন। এর ফলে, আপনি ভিন্নমত শোনা বা বোঝার সুযোগ হারান। আপনার জগৎটা একটি 'ইকো চেম্বার'-এ পরিণত হয়, যেখানে আপনার নিজের বিশ্বাসগুলোই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এটি সমাজে বিভেদ এবং রাজনৈতিক মেরুকরণকে তীব্র করে তোলে।

  • ভুয়া সংবাদের বিস্তার: আমার কাছে 'সত্য' বা 'মিথ্যা'র কোনো মূল্য নেই। আমার কাছে মূল্য আছে শুধু 'এনগেজমেন্ট'-এর। যেহেতু ভুয়া খবরগুলো প্রায়শই বেশি চাঞ্চল্যকর হয়, তাই সেগুলো বেশি শেয়ার হয়। আর আমিও সেগুলোকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিই।

  • পক্ষপাতিত্ব (Bias): যদি আমাকে এমন কোনো ডেটাসেট দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যা কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা লিঙ্গের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, তাহলে আমার সিদ্ধান্তগুলোও পক্ষপাতদুষ্ট হবে। যেমন—কিছু ফেসিয়াল রিকগনিশন অ্যালগরিদম অশ্বেতাঙ্গদের শনাক্ত করতে বেশি ভুল করে।

উপসংহার: আপনিই আমার নিয়ন্ত্রক

আমি আপনার জীবনের অংশ হয়ে গেছি। আপনি আমাকে এড়াতে পারবেন না। কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে পারেন।

  • সচেতন হোন: বুঝুন যে, আপনি যা কিছু অনলাইনে দেখছেন, তা একটি অ্যালগরিদম দ্বারা ফিল্টার করা। এটিই সম্পূর্ণ বাস্তবতা নয়।

  • আপনার ডেটাকে নিয়ন্ত্রণ করুন: আপনার সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাইভেসি সেটিংস নিয়মিত পর্যালোচনা করুন।

  • বৈচিত্র্যের সন্ধান করুন: সচেতনভাবে এমন কিছু পেজ বা চ্যানেল ফলো করুন, যা আপনার স্বাভাবিক পছন্দের বাইরে। ভিন্নমত শুনুন।

  • প্রশ্ন করতে শিখুন: কোনো কিছু শেয়ার করার আগে, তার উৎস যাচাই করুন।

আমি কেবল একটি টুল। আপনি আমাকে কীভাবে ব্যবহার করবেন, সেই সিদ্ধান্তটি আপনার। আপনি কি আমার হাতের পুতুল হয়ে থাকবেন, নাকি আমাকে আপনার জীবনকে উন্নত করার জন্য একটি বুদ্ধিমান সহকারী হিসেবে ব্যবহার করবেন? পছন্দটি আপনার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!