জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সংকট: জাপানের 'সিলভার সুনামি' এবং বার্ধক্যের মুখে বিশ্ব

0



ফিল্ড নোটস: ডেমোগ্রাফার ড. আরিয়া চৌধুরী 

বিষয়: বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার বার্ধক্যজনিত সংকট এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রভাব বিষয়ক একটি মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ।

লগ এন্ট্রি ১: টোকিও, জাপান। আজ আমি টোকিওর সুগামো জেলায় হেঁটে বেড়াচ্ছি। এই জায়গাটি স্থানীয়ভাবে 'হারাজুকু অফ দ্য গ্রান্ডমাস' বা 'নানি-নানিদের হারাজুকু' নামে পরিচিত। এখানকার দোকানগুলোতে তরুণদের জন্য ফ্যাশনেবল পোশাকের বদলে, বয়স্কদের জন্য আরামদায়ক জুতো এবং ওয়াকিং স্টিক বিক্রি হয়। এখানকার ক্যাফেগুলোতে উচ্চস্বরে পপ মিউজিকের বদলে, ধীরগতির পুরনো দিনের গান বাজে।

সুগামো হলো জাপানের বর্তমান এবং বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের ভবিষ্যতের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। জাপান এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী সুনামির সম্মুখীন—এটি কোনো জলস্রোত নয়, এটি 'সিলভার সুনামি' বা প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স এখন ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারগুলোর একটি। এর ফলস্বরূপ, জাপানের জনসংখ্যা গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে।

আমি একটি স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে গেলাম। সেখানে কয়েকজন প্রবীণ 'গো' খেলা খেলছিলেন। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তাদের সন্তানরা কাজের জন্য টোকিওর বাইরে থাকেন, বছরে একবার বা দুইবার দেখা হয়। তাদের অনেকেরই কোনো নাতি-নাতনি নেই। এই একাকীত্বই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্গী। এই সংকট কেবল সামাজিক নয়, অর্থনৈতিকও। এত বিশাল সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত মানুষের পেনশন এবং স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটানোটা দেশের কর্মক্ষম তরুণ প্রজন্মের জন্য এক বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লগ এন্ট্রি ২: একটি নামহীন গ্রাম, গ্রামীস, ইতালি। টোকিওর কংক্রিটের জঙ্গল থেকে আমি এসেছি ইতালির এক পাহাড়ি গ্রামে। এখানকার দৃশ্যপট ভিন্ন, কিন্তু গল্পটা একই। এই গ্রামের পাথুরে রাস্তাগুলো খাঁ খাঁ করছে। অনেক বাড়ির দরজা-জানালায় ধুলার আস্তর, তালা ঝুলছে। গ্রামের একমাত্র স্কুলটি বহু বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ সেখানে ভর্তি হওয়ার মতো কোনো শিশুই আর ছিল না।

ইতালি, জাপানের মতোই, বিশ্বের অন্যতম বয়স্ক জনসংখ্যার দেশ। এখানকার তরুণ প্রজন্ম কাজের সন্ধানে মিলান, রোম বা দেশের বাইরে চলে গেছে। গ্রামে রয়ে গেছেন কেবল তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা। আমি গ্রামের মেয়রের সাথে কথা বললাম, যিনি নিজেও একজন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। তিনি জানালেন, "আমাদের গ্রামে এখন মৃত্যুর হার জন্মহারের চেয়ে দশগুণ বেশি। আমরা কোনো যুদ্ধ বা মহামারীর মধ্যে নেই, কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছি।"

এই 'ঘোস্ট টাউন' বা ভূতুড়ে গ্রামগুলো ইউরোপের বুকে এক নীরব সতর্কবার্তা। এটি দেখাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা যখন নিম্ন জন্মহারের সাথে মিলিত হয়, তখন তা একটি সমাজকে ভেতর থেকে কীভাবে শূন্য করে দিতে পারে।

লগ এন্ট্রি ৩: সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া। আমার শেষ গন্তব্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, যে দেশটি বর্তমানে বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের রেকর্ডের অধিকারী। এখানকার সংকটটি জাপানের চেয়েও গভীর এবং জটিল। সিউলের রাস্তায় আমি যা দেখলাম, তা হলো এক তীব্র প্রতিযোগিতা। শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে প্রবেশের জন্য কোচিং করে। তরুণরা দিনে ১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। আর কর্মজীবনে প্রবেশের পর শুরু হয় আরেক অন্তহীন প্রতিযোগিতা। আমি কয়েকজন তরুণ দম্পতির সাথে কথা বললাম। তারা জানালেন, সিউলে একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টের দাম এবং একটি সন্তানের পড়াশোনার খরচ এতটাই বেশি যে, তারা সন্তান নেওয়ার কথা ভাবতেই ভয় পান। নারীরা বলছেন, সন্তান নিলে তাদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

দক্ষিণ কোরিয়ার গল্পটি আমাদের শেখায় যে, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সংকট কেবল সংখ্যার খেলা নয়। এর গভীরে লুকিয়ে আছে গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চাপ, যা মানুষকে পরিবার গঠনের মতো একটি মৌলিক মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখছে।

বিশ্লেষণ: সঙ্কুচিত বিশ্বের সাধারণ কারণসমূহ আমার এই মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে, আমি জনসংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি সাধারণ চালিকাশক্তি শনাক্ত করেছি:

  • অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নারী শিক্ষা: এটি একটি প্যারাডক্স। যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নারী শিক্ষা একটি দেশের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য, তা-ই জন্মহার কমার অন্যতম প্রধান কারণ। নারীরা যখন উচ্চশিক্ষা এবং ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা দেরিতে বিয়ে করেন এবং কম সন্তান নেন।

  • উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়: আধুনিক শহরগুলোতে, বিশেষ করে আবাসন এবং শিক্ষার ব্যয় এতটাই বেশি যে, একটি বড় পরিবার পালন করা অনেক দম্পতির জন্যই আর্থিকভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

  • সামাজিক পরিবর্তন: পরিবার এবং বিবাহ সংক্রান্ত ঐতিহ্যবাহী ধারণাগুলো বদলে যাচ্ছে। অনেকেই এখন ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

  • পেনশন এবং সামাজিক নিরাপত্তা: উন্নত দেশগুলোতে শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকায়, বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের উপর নির্ভর করার প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে, যা ঐতিহাসিকভাবে বড় পরিবারের একটি প্রধান কারণ ছিল।

ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি: প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক শীত বা 'ডেমোগ্রাফিক উইন্টার'-এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী:

  • অর্থনৈতিক স্থবিরতা: কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমে গেলে, একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। ভোক্তা চাহিদা কমে যায় এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা হ্রাস পায়।

  • পেনশন এবং স্বাস্থ্যসেবা সংকট: কম সংখ্যক কর্মী এবং বেশি সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত মানুষ—এই সমীকরণটি যেকোনো দেশের পেনশন এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

  • ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন: যে দেশগুলোর জনসংখ্যা তরুণ এবং ক্রমবর্ধমান, তারা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক মঞ্চে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের নীতি গ্রহণ করার চেষ্টা করছে—যেমন, সন্তান পালনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ছুটি এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রদান (ফ্রান্স), অভিবাসনকে উৎসাহিত করা (কানাডা), এবং বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার জন্য রোবটিক্সের ব্যবহার (জাপান)। তবে, এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। এটি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ, যা আমাদের সমাজ, অর্থনীতি এবং পরিবার সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!