মুরগির কোর্টকাচারি

0

গ্রামের মানুষকে আপনি তিনটা জিনিস থেকে আলাদা করতে পারবেন না— ধান, রাজনীতি আর মুরগি। ধান হলো পেটের প্রশ্ন, রাজনীতি হলো পেটের ভেতরের আগুন, আর মুরগি হলো চায়ের আড্ডার সেরা আলাপ।

আমাদের চরগাঁও গ্রামে আজ যা ঘটল, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে— “মুরগির কোর্টকাচারি”।

ঘটনার শুরু হয় গত সপ্তাহে। গফুর মিয়া নামের এক মানুষ, যার গলা বাজারে মাইক ভাড়া দেওয়া রাজনীতিবিদদের থেকেও জোরে বাজে, তিনি ঘোষণা দিলেন, তার প্রিয় দেশি মুরগি ‘শেফালি’ উধাও হয়ে গেছে। গফুর মিয়া এমনভাবে কাঁদতে শুরু করলেন, মনে হলো পুরো গ্রাম থেকে গরু-ছাগল উধাও হয়ে গেছে।

তিনি বললেন, “এই শেফালি আমার প্রাণ! আমি ওরে সাত বছর ধরে লালন করছি, গরমে পানিতে ভিজাইছি, শীতে গরম আগুনের পাশে রাখছি। একবার তো ডাক্তার দেখাইছি শহরে!”

শুনে সবাই অবাক— মুরগিকে আবার শহরে ডাক্তার দেখানো হয় নাকি! কিন্তু গফুর মিয়া শপথ করলেন, “যে আমার শেফালিকে চুরি করছে, সে গ্রামে বাঁচবে না!”

তখনই মুরুব্বি মজিদ মাস্টার ঘোষণা দিলেন, “এখন থেকে এই ব্যাপারে কোর্ট বসবে। বিচার হবে, দোষী ধরা পড়বে।”

পরদিন দুপুরে গ্রামের স্কুল মাঠে বসলো আদালত। চেয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলো পুরনো একটা টেবিল, যার ওপর মুরগির আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট। চেয়ারম্যান হিসেবে বসলেন মজিদ মাস্টার। চারদিকে জনতা ভিড়। যেন এটা কোনো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা।

প্রথমে সাক্ষী হিসেবে হাজির হলো সেকেন্ডারি সাক্ষী রহিম। সে শপথ করে বলল, “আমি স্পষ্ট দেখছি, কাল রাতে কুদ্দুসের উঠানে একটা মুরগি ঢুকছে।”

কুদ্দুস লাফিয়ে উঠল, “হুজুর, মুরগি ঢুকলেই কি সেটা আমার হয়ে যায়? বাজারে গেলে অনেক লোক আমার দোকানে ঢুকে, তার মানে কি আমি সবাইকে কিনে ফেলি?”

জনতা হেসে লুটোপুটি। বিচারক মজিদ মাস্টার হাত উঁচু করে বললেন, “চুপ! এটা কোর্ট, সার্কাস না।”

দ্বিতীয় সাক্ষী হাজির হলো— হাজেরা খালা। তিনি বললেন, “আমি রাতে ঝোপের ভেতর থেকে একটা কক্কর ডাক শুনছি। ওই ডাক আমার জানাশোনা, নিশ্চিত শেফালির।”

শুনেই কোর্টে শোরগোল। গফুর মিয়া চিৎকার করলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার শেফালির ডাক আমি অন্ধ হলেও চিনতে পারি।”

তখন চেয়ারম্যান গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “হাজেরা, তুমি কীভাবে প্রমাণ করবে, ডাকটা শেফালিরই ছিল?”

হাজেরা গর্ব করে বললেন, “আমি তের বছর ধরে মুরগি পালছি। ডাক চিনতে আমার ডিগ্রি আছে।”

শুনে আবার হাসির রোল।

এরপর আনা হলো আসামি— কুদ্দুস। কুদ্দুসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে নাকি মুরগি চুরি করেছে। কুদ্দুস হাত নেড়ে বলল, “আমি নির্দোষ! আমার বাসায় মুরগি তো আছেই, আমি আবার চুরি করব কেন?”

তখন গফুর মিয়া নাটকীয় ভঙ্গিতে এক ঝুড়ি মুরগি নিয়ে এলেন। ঝুড়ি থেকে একটার পর একটা মুরগি বের করছেন আর বলছেন, “দেখেন, এগুলো আমার না। আমার শেফালি আলাদা। তার চোখে প্রেম, ডাকে টান, আর লেজে রঙ।”

কোর্টে একে একে ১০টা মুরগি হাজির হলো। কিন্তু শেফালি নেই।

হঠাৎ করে স্কুলের মাঠের পেছন থেকে একটা ডিম গড়াতে গড়াতে এসে পড়ল টেবিলের নিচে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কোথা থেকে ডিম এলো?

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিল সেই শেফালি!

মুরগি নিজেরে লুকিয়ে আদালত চালাচ্ছিল, এটা ভেবে সবাই হাঁ হয়ে গেল।

গফুর মিয়া ছুটে গিয়ে মুরগিকে কোলে নিয়ে বললেন, “ও মা! তুই কোর্টে বসে আছিস! আমার প্রাণ ফিরে এলো।”

তখন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন, “শেফালি যেহেতু নিজে হাজির, তাই কেস খারিজ।”

কিন্তু এখানেই নাটক শেষ হলো না।

কুদ্দুস ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আমি দোষী না হয়েও সবাই আমাকে চোর বানাল। এর বিচার চাই।”

তখন চেয়ারম্যান বললেন, “আচ্ছা, যেহেতু শেফালি নিজে ধরা খাইছে, তাই আসামি মুক্ত। কিন্তু গফুর মিয়া যেহেতু গ্রামের সবাইকে বিরক্ত করল, তার শাস্তি হবে— সে এক সপ্তাহ গ্রামের সবার জন্য ভুনা মুরগি রান্না করবে।”

গফুর মিয়া কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, “আমার প্রাণের শেফালি বাঁচলো, কিন্তু অন্য মুরগি গেল!”

এইভাবে গ্রামে দিনশেষে একটা মহাভোজ হলো। সবাই হেসে খেয়ে আনন্দ করল। আর গ্রামের নাম হয়ে গেল— “মুরগির কোর্টকাচারির গ্রাম”।

পরের দিন বাজারে হকাররা ডাকতে শুরু করল,
“এগিয়ে আসুন, গরম খবর! গরম খবর! চরগাঁও গ্রামে কোর্ট বসেছিল মুরগির নামে!”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!