ই-বর্জ্য কি? একটি স্মার্টফোনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আত্মকথন

0

আমার জন্ম হয়েছিল চীনের শেনঝেনের এক বিশাল, কোলাহলপূর্ণ কারখানায়। আমার কোনো নাম ছিল না, ছিল শুধু একটি সিরিয়াল নম্বর। শত শত কর্মীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় আমার জন্ম। আমার শরীরে মিশেছিল কঙ্গোর খনি থেকে তুলে আনা কোবাল্ট, আমার মস্তিষ্কের (প্রসেসর) জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল সিলিকনের পাতলা ওয়েফার, আর আমার শরীরটাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল ঝকঝকে অ্যালুমিনিয়াম আর গরিলা গ্লাসের এক সুন্দর আবরণে। আমি ছিলাম প্রযুক্তির এক বিস্ময়, এক নতুন ফ্ল্যাগশিপ মডেল।

আমার জন্মের পর আমাকে একটি সাদা, মিনিমালিস্টিক বাক্সে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো হাজার হাজার মাইল দূরের এক দেশে। আমার প্রথম স্মৃতি হলো, যখন একজন তরুণ, যার নাম ছিল আরিয়ান, সে খুব যত্ন করে আমার বাক্সটি খুলল। আমার স্ক্রিন থেকে প্লাস্টিকের আবরণটি তুলে ফেলার সময় যে হালকা শব্দটা হয়েছিল, আরিয়ানের চোখেমুখে তখন যে আনন্দ আমি দেখেছিলাম, সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। আমি ছিলাম তার নতুন সঙ্গী, তার স্বপ্নের অংশ।

আমার সোনালী দিনগুলো আরিয়ানের হাতে আমার জীবনটা ছিল অসাধারণ। আমি তার পৃথিবীর জানালা হয়ে উঠেছিলাম। আমার ক্যামেরায় সে তার প্রথম সন্তানের মুখ দেখেছিল, বন্ধুর বিয়ের ছবি তুলেছিল, আর তুলেছিল পরিবারের সাথে কাটানো অসংখ্য আনন্দের মুহূর্ত। আমার স্ক্রিনে সে তার প্রিয় দলের খেলা দেখত, নতুন রেসিপি শিখত, আর গভীর রাতে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করত। আমি তার অ্যালার্ম হয়ে তাকে সকালে জাগিয়ে দিতাম, তার ক্যালেন্ডার হয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং মনে করিয়ে দিতাম। আমি কেবল একটি যন্ত্র ছিলাম না, আমি ছিলাম তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার স্মৃতির এক বিশ্বস্ত ধারক।

ধীরগতির মৃত্যু এবং পরিত্যক্ত হওয়া কিন্তু সময় বদলায়। প্রায় দুই বছর পর, আমি ধীরে ধীরে ক্লান্ত হতে শুরু করলাম। আমার ব্যাটারি আর আগের মতো সারাদিন চলত না। নতুন, ভারী অ্যাপগুলো খুলতে আমার কিছুটা বেশি সময় লাগত। আমার নির্মাতা একটি নতুন সফটওয়্যার আপডেট পাঠিয়েছিল, যা আমাকে আরও ধীর করে দিল। আরিয়ান মাঝে মাঝে বিরক্ত হতো।

এরপরই বাজারে এলো আমার পরবর্তী, আরও নতুন এবং আরও চকচকে সংস্করণ। তার ক্যামেরা নাকি আরও ভালো, প্রসেসর আরও দ্রুত। আরিয়ানের বন্ধুরা সবাই সেই নতুন মডেলটি কিনছিল। একদিন, আরিয়ানও একটি নতুন ফোন নিয়ে বাড়ি ফিরল। সে আমার ভেতর থেকে তার সিম কার্ড এবং ডেটাগুলো নতুন ফোনে নিয়ে নিল। এরপর, সে আমাকে তার ড্রয়ারের এক কোণায় রেখে দিল।

সেই ড্রয়ারের অন্ধকারে আমি महीनों, তারপর বছর কাটিয়ে দিলাম। আমার ব্যাটারি পুরোপুরি মরে গেল। আমার স্ক্রিনে জমল ধুলার আস্তর। আমি আর কারো পৃথিবীর জানালা ছিলাম না, আমি ছিলাম এক ভুলে যাওয়া অতীত।

এক দীর্ঘ এবং বিষাক্ত যাত্রা একদিন, ঘর পরিষ্কার করার সময়, আরিয়ান আমাকে অন্যান্য পুরনো ইলেকট্রনিক্সের সাথে একটি ময়লার ব্যাগে ভরে ফেলে দিল। এখান থেকেই শুরু হলো আমার জীবনের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়—আমার 'ই-বর্জ্য' বা 'e-waste' হয়ে ওঠার যাত্রা।

আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো শহরের এক বিশাল বর্জ্য সংরক্ষণ কেন্দ্রে। সেখান থেকে, আমার মতো হাজার হাজার পুরনো ফোন, ল্যাপটপ, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্সকে একটি বিশাল কন্টেইনারে ভরা হলো। আমাদের নতুন গন্তব্য ছিল আফ্রিকার কোনো এক দেশ, সম্ভবত ঘানার আক্রা। আমাদের কাগজপত্রে লেখা ছিল 'সেকেন্ড-হ্যান্ড গুডস' বা 'ব্যবহৃত পণ্য', কিন্তু আমরা সবাই জানতাম, এটা একটা মিথ্যা কথা। আমরা ছিলাম উন্নত বিশ্বের ডিজিটাল আবর্জনা, যা আইনি এবং বেআইনি পথে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আগবগব্লোশি: পৃথিবীর ডিজিটাল নরক কয়েক সপ্তাহ পর, আমাদের কন্টেইনার টি নামানো হলো ঘানার আগবগব্লোশি নামক এক জায়গায়। এটি কোনো সাধারণ ডাম্পইয়ার্ড নয়। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ভাগাড়। এখানে আমি যা দেখলাম, তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।

মাইলের পর মাইল জুড়ে পড়ে আছে পুরনো কম্পিউটার, মনিটর, ফ্রিজ, এবং আমার মতো লক্ষ লক্ষ ফোনের মৃতদেহ। এখানকার বাতাস ভারী এবং বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ছোট ছোট শিশুরা, যাদের স্কুলে থাকার কথা, তারা খালি পায়ে এই বিষাক্ত আবর্জনার স্তূপের উপর দিয়ে হাঁটছে। তাদের কাজ হলো, আমাদের মতো পুরনো ইলেকট্রনিক্সগুলোকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে এর ভেতর থেকে তামা, অ্যালুমিনিয়াম, এবং সোনার মতো মূল্যবান ধাতুগুলো বের করা।

আমার শরীরটাকে একটি পাথরের উপর রেখে এক কিশোর হাতুড়ি দিয়ে ভাঙতে শুরু করল। আমার সুন্দর স্ক্রিনটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। আমার ভেতরের সার্কিট বোর্ড থেকে সে মূল্যবান কপার বের করার চেষ্টা করছিল। এরপর, আমার প্লাস্টিকের শরীরটাকে এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় অংশগুলোকে একটি বড় স্তূপে ফেলে দেওয়া হলো এবং সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো।

আমার শরীরটা যখন পুড়ছিল, তখন আমার ভেতর থেকে নির্গত হচ্ছিল সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম এবং অন্যান্য মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। এই বিষাক্ত ধোঁয়া সেখানকার বাতাসে মিশে যাচ্ছিল, যা সেখানকার কর্মীদের ফুসফুসে প্রবেশ করছিল। পোড়া প্লাস্টিকের তরল অংশ মাটিতে চুইয়ে পড়ছিল, যা সেখানকার মাটি এবং ভূগর্ভস্থ পানিকে চিরতরে বিষাক্ত করে দিচ্ছিল।

একটি নীরব ঘাতকের গল্প আমি এখন এই বিশাল বর্জ্যের স্তূপের একটি অংশ। কিন্তু আমার গল্প এখানেই শেষ নয়।

  • পরিবেশগত প্রভাব: আমার মতো প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৫০ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়। এর একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার বা 'রিসাইকেল' করা হয়। বাকি বিশাল অংশটিই আগবগব্লোশির মতো জায়গায় গিয়ে আমাদের মাটি, পানি এবং বাতাসকে বিষাক্ত করে চলেছে।

  • স্বাস্থ্যগত প্রভাব: এই ই-বর্জ্যের সংস্পর্শে কাজ করা মানুষগুলো, বিশেষ করে শিশুরা, মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের মধ্যে ক্যান্সার, ফুসফুসের রোগ, মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং জন্মগত ত্রুটির হার অত্যন্ত বেশি।

  • 'প্ল্যানড অব্সোলেসেন্স' (Planned Obsolescence): আমার নির্মাতারা আমাকে এমনভাবেই তৈরি করেছিল, যাতে আমি কয়েক বছর পরেই পুরনো এবং অকেজো হয়ে যাই। তারা ইচ্ছা করেই আমার ব্যাটারি পরিবর্তন করাটা কঠিন করে দিয়েছিল। এই 'পরিকল্পিত अप्रচলন' নীতিটিই এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরির মূল কারণ।

যদি অন্যরকম হতে পারত? আমার এই করুণ পরিণতি এড়ানো যেত। যদি আরিয়ান আমাকে ফেলে না দিয়ে, কোনো একটি সঠিক 'ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং' কেন্দ্রে দিয়ে আসত, তাহলে আমার ভেতরের মূল্যবান ধাতুগুলোকে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই পুনরুদ্ধার করা যেত। যদি আমার নির্মাতারা আমাকে আরও সহজে মেরামতযোগ্য করে তৈরি করত, তাহলে হয়তো একটি নতুন ব্যাটারি লাগিয়েই আমি আরও কয়েক বছর চলতে পারতাম।

আমার গল্পটি একটি মাত্র স্মার্টফোনের গল্প। কিন্তু এটিই বিশ্বের লক্ষ লক্ষ টন ইলেকট্রনিক বর্জ্যের গল্প। এটি আমাদের 'ব্যবহার করো আর ফেলে দাও' সংস্কৃতির এক ভয়াবহ পরিণতি। তাই, পরেরবার যখন আপনি আপনার নতুন চকচকে গ্যাজেটটি কিনবেন, তখন একবারের জন্য হলেও আপনার পুরনো যন্ত্রটির কথা ভাববেন। তার শেষ পরিণতি যেন আগবগব্লোশির বিষাক্ত আগুনে না হয়, সেই দায়িত্বটুকু আমাদের সবার।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!