প্রবাসী জীবনের আর্থিক পরিকল্পনা: বাজেট, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের সম্পূর্ণ গাইড

0


বিশেষ প্রতিবেদন, ১৬ অক্টোবর:
প্রবাস জীবন একটি দ্বৈত তরবারি। একদিকে যেমন রয়েছে উন্নত জীবনযাত্রা এবং মোটা অংকের আয়ের হাতছানি, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে পরিবার ছেড়ে থাকার কষ্ট এবং ভবিষ্যতের এক গভীর অনিশ্চয়তা। অনেক প্রবাসীই তাদের যৌবনের সেরা সময়টা বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করে কাটিয়ে দেন, কিন্তু সঠিক আর্থিক পরিকল্পনার অভাবে, দেশে ফেরার সময় তাদের হাতে তেমন কোনো সঞ্চয় থাকে না। একটিমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত বা একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা তাদের বহু বছরের পরিশ্রমকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।

আর্থিক পরিকল্পনা কোনো রকেট সায়েন্স নয়। এটি হলো আপনার কষ্টার্জিত অর্থকে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচালনা করার একটি শিল্প, যা আপনাকে কেবল বর্তমানের প্রয়োজন মেটাতেই সাহায্য করবে না, বরং আপনার ভবিষ্যৎকেও সুরক্ষিত করবে। এই প্রতিবেদনটি কোনো সাধারণ টিপসের তালিকা নয়। এটি হলো আপনার প্রবাস জীবনের জন্য একটি সম্পূর্ণ আর্থিক 'ব্লুপ্রিন্ট', যা আপনাকে ধাপে ধাপে শেখাবে কীভাবে একটি কার্যকর বাজেট তৈরি করতে হয়, কীভাবে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়, এবং কীভাবে সেই সঞ্চয়কে সঠিক পথে বিনিয়োগ করে আপনার সম্পদ বৃদ্ধি করতে হয়।

প্রথম অধ্যায়: ভিত্তিপ্রস্তর—আপনার আর্থিক স্বাস্থ্যের নিরীক্ষা যেকোনো ইমারত গড়ার আগে তার ভিত্তি পরীক্ষা করা জরুরি।

  • আপনার আয় এবং ব্যয়ের হিসাব: প্রথম কাজটি হলো, গত তিন মাসের আপনার সমস্ত আয় এবং ব্যয়ের একটি নিখুঁত হিসাব বের করা। একটি ডায়েরি বা মোবাইলের স্প্রেডশিট অ্যাপ (যেমন: Google Sheets) ব্যবহার করুন। প্রতিটি ছোট খরচ—এক কাপ চা থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথে একবেলা খাওয়া পর্যন্ত—সবকিছু লিখে রাখুন। এই প্রক্রিয়াটি হয়তো বিরক্তিকর, কিন্তু এটি আপনাকে একটি পরিষ্কার চিত্র দেবে যে, আপনার টাকা আসলে কোথায় যাচ্ছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: নকশা প্রণয়ন—৫০/৩০/২০ বাজেট রুল একবার আপনার আয়-ব্যয়ের চিত্রটি পরিষ্কার হয়ে গেলে, अब একটি বাজেট বা আর্থিক নকশা তৈরি করার পালা। নতুনদের জন্য, "৫০/৩০/২০ রুল" একটি অত্যন্ত কার্যকর এবং সহজ পদ্ধতি। এই নিয়ম অনুযায়ী, আপনি আপনার মাসিক মোট আয়কে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করবেন।

  • ১. ৫০% প্রয়োজনের জন্য (Needs):

    • এই ভাগে থাকবে সেইসব খরচ, যা ছাড়া আপনার জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভব।

    • উদাহরণ:

      • বাসা ভাড়া: আপনার বেতনের সবচেয়ে বড় অংশটি সম্ভবত এখানেই ব্যয় হবে।

      • খাওয়া-দাওয়া: দৈনন্দিন খাবারের খরচ।

      • যাতায়াত: বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার খরচ।

      • ইউটিলিটি বিল: বিদ্যুৎ, পানি, এবং ইন্টারনেট বিল।

      • দেশে টাকা পাঠানো (অপরিহার্য অংশ): আপনার পরিবারের মৌলিক চাহিদা (যেমন: খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা, সন্তানের পড়াশোনা) মেটানোর জন্য যে টাকাটা আপনাকে প্রতি মাসে পাঠাতেই হয়।

  • ২. ৩০% আকাঙ্ক্ষার জন্য (Wants):

    • এই ভাগে থাকবে সেইসব খরচ, যা আপনার জীবনকে আরও আনন্দময় করে তোলে, কিন্তু যেগুলো অপরিহার্য নয়।

    • উদাহরণ:

      • বাইরে খাওয়া-দাওয়া: বন্ধুদের সাথে রেস্তোরাঁয় যাওয়া।

      • কেনাকাটা: নতুন পোশাক, গ্যাজেট বা পারফিউম কেনা।

      • বিনোদন: সিনেমা দেখা বা ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া।

      • দেশে টাকা পাঠানো (ঐচ্ছিক অংশ): পরিবারের কোনো বিশেষ আবদার বা বিলাসিতার জন্য অতিরিক্ত টাকা পাঠানো।

  • ৩. ২০% সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের জন্য (Savings & Investments):

    • এটিই আপনার ভবিষ্যতের ভিত্তি। এই নিয়মটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হলো, "Pay Yourself First" বা "সবার আগে নিজেকে পরিশোধ করুন"। অর্থাৎ, মাস শেষে যা অবশিষ্ট থাকবে, তা সঞ্চয় না করে, মাসের শুরুতেই আপনার আয়ের কমপক্ষে ২০ শতাংশ সঞ্চয়ের জন্য আলাদা করে ফেলুন। বাকি ৮০ শতাংশ দিয়ে আপনার পুরো মাস চালানোর অভ্যাস করুন।

তৃতীয় অধ্যায়: ইমারত নির্মাণ—সঞ্চয়ের কার্যকরী কৌশল

  • ১. দুটি ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন:

    • একটি অ্যাকাউন্ট রাখুন আপনার দৈনন্দিন খরচের জন্য (Salary Account)। অন্য একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলুন, যেখানে কোনো ডেবিট কার্ড থাকবে না। মাসের শুরুতে, আপনার নির্ধারিত সঞ্চয়ের (২০%) টাকাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্যালারি অ্যাকাউন্ট থেকে সেভিংস অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করুন।

  • ২. জরুরি তহবিল (Emergency Fund) তৈরি করুন:

    • এটি আপনার আর্থিক পরিকল্পনার 'ফায়ার এক্সটিংগুইশার'। আপনার লক্ষ্য হবে, আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্টে কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ মাসের মোট জীবনযাত্রার খরচের সমপরিমাণ অর্থ জমা করা। এই টাকাটি আপনি কখনোই, কোনো অবস্থাতেই স্পর্শ করবেন না, যদি না কোনো চরম জরুরি পরিস্থিতি (যেমন: হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়া বা বড় ধরনের অসুস্থতা) তৈরি হয়।

  • ৩. ছোট ছোট খরচ কমান:

    • প্রতিদিন বাইরে কফি না খেয়ে, নিজে বানিয়ে খান।

    • অপ্রয়োজনীয় সাবস্ক্রিপশন (যেমন: যে স্ট্রিমিং সার্ভিসটি আপনি দেখেন না) বাতিল করুন।

চতুর্থ অধ্যায়: চূড়ান্ত সজ্জা—বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি আপনার জরুরি তহবিল তৈরি হয়ে যাওয়ার পর, এখন সময় আপনার টাকাকে আপনার জন্য কাজ করানোর। সঞ্চয় আপনাকে সুরক্ষিত রাখে, কিন্তু বিনিয়োগ আপনার সম্পদকে বৃদ্ধি করে।

  • ১. বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ:

    • ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড: এটি প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সবচেয়ে নিরাপদ এবং আকর্ষণীয় বিনিয়োগগুলোর একটি। এতে বিনিয়োগ করলে আপনি উচ্চ হারে (প্রায় ১২%) মুনাফা পান এবং আপনার বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর কোনো কর দিতে হয় না।

    • ডিপিএস (Deposit Pension Scheme): বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংকে একটি ডিপিএস অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে, মেয়াদ শেষে আপনি একটি বড় অংকের টাকা প্রস্তুত মুনাফা ফেরত পাবেন।

    • স্থায়ী আমানত (Fixed Deposit - FDR): একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা রেখে আকর্ষণীয় হারে সুদ পেতে পারেন।

    • শেয়ার বাজার: এটি উচ্চ ঝুঁকির এবং উচ্চ লাভের একটি ক্ষেত্র। যদি আপনার এই বিষয়ে জ্ঞান না থাকে, তাহলে সরাসরি বিনিয়োগ না করে, অভিজ্ঞ কোনো ব্রোকারেজ হাউসের পরামর্শ নিন অথবা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন।

    • রিয়েল এস্টেট: দেশে জমি বা ফ্ল্যাট কিনে রাখাও একটি জনপ্রিয় দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ।

  • ২. বিদেশে বিনিয়োগ (যদি আইন অনুমতি দেয়):

    • আপনি যে দেশে আছেন, সেখানকার স্টক মার্কেট বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের সুযোগ সম্পর্কেও খোঁজ নিতে পারেন।

গুরুত্বপূর্ণ নোট: বিনিয়োগ করার আগে, সর্বদা মুদ্রাস্ফীতির হারকে মাথায় রাখবেন। আপনার বিনিয়োগের মুনাফার হার যদি মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম হয়, তাহলে বাস্তবে আপনার সম্পদের মূল্য কমে যাচ্ছে।

এই আর্থিক ব্লুপ্রিন্টটি অনুসরণ করা হয়তো প্রথম দিকে কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, এটি আপনার অভ্যাসে পরিণত হবে। মনে রাখবেন, প্রবাস জীবন একটি সাময়িক অধ্যায়। এই অধ্যায়টি শেষ হওয়ার পর, আপনি যেন খালি হাতে দেশে না ফেরেন, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনারই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!