অদৃশ্য নায়িকারা: মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিপিনো গৃহকর্মীদের ত্যাগ ও স্বপ্নের গল্প

0


বিশেষ প্রতিবেদন, ২৫ সেপ্টেম্বর:
 দুবাইয়ের একটি সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্টের ঝকঝকে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছেন মারিয়া রেয়েস। বয়স ৩৫। তিনি নিখুঁতভাবে একটি কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট তৈরি করছেন—প্যানকেক, স্ক্র্যাম্বলড এগস, আর ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস। কিছুক্ষণ পরেই, তিনি তার নিয়োগকর্তার দুই সন্তানকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করবেন। তাদের খাইয়ে, পোশাক পরিয়ে, স্কুলে পাঠিয়ে, তারপর তিনি শুরু করবেন এই বিশাল অ্যাপার্টমেন্টটি পরিষ্কার করার কাজ। মারিয়ার দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়, আর শেষ হয় রাত দশটায়।

মারিয়া হলেন মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত মিলিয়ন মিলিয়ন ফিলিপিনো প্রবাসী কর্মী বা Overseas Filipino Workers (OFWs)-এর একজন প্রতিনিধি। তাদের অনেকেই গৃহকর্মী, আয়া, বা কেয়ারগিভার হিসেবে কাজ করেন। তারা হলেন এই অঞ্চলের অনেক পরিবারের 'অদৃশ্য' মেরুদণ্ড। তারা অন্যের ঘরকে নিজের ঘরের মতো করে সাজিয়ে রাখেন, অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো করে ভালোবাসেন। কিন্তু এই হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকে তাদের নিজেদের পরিবার ছেড়ে আসার এক বুকভরা কষ্ট, একাকিত্ব এবং অকল্পনীয় ত্যাগের এক নীরব গল্প।

প্রথম অধ্যায়: একটি কঠিন সিদ্ধান্ত ফিলিপাইন্সের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে, মারিয়ার দুটি ছোট ছোট সন্তান আছে, যাদের মুখ সে গত দুই বছর ধরে কেবল ফোনের স্ক্রিনেই দেখেছে। তার স্বামী একজন কৃষক, যার আয় দিয়ে সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ানো বা পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো সম্ভব ছিল না।

"আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যতের জন্যই আমাকে এই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছিল," এক ছুটির দিনে, অন্য ফিলিপিনো বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় বলেন মারিয়া। "আমি চাই না, আমার মতো আমার সন্তানরাও দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হোক। আমি যখন প্রথমবার এয়ারপোর্টে আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে ছেড়ে আসি, তখন মনে হচ্ছিল আমার বুকের একটা অংশ আমি সেখানেই ফেলে আসছি। সেই কষ্টটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।"

মারিয়ার এই গল্পটিই প্রায় প্রতিটি ফিলিপিনো গৃহকর্মীর গল্প। তারা 'আধুনিক যুগের নায়িকা' বা 'Bagong Bayani' হিসেবে পরিচিত, কারণ তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স ফিলিপাইন্সের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।

দ্বিতীয় অধ্যায়: দেয়ালের ভেতরের জীবন তাদের কর্মজীবন কাটে একটি 'লাইভ-ইন' ವ್ಯವಸ್ಥೆ-তে। অর্থাৎ, তারা তাদের নিয়োগকর্তার বাড়িতেই ২৪ ঘণ্টা থাকেন। এর কিছু সুবিধা থাকলেও, এর অন্ধকার দিকও রয়েছে।

  • একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা: তাদের জগৎটা হয়ে যায় সেই বাড়িটির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাইরের জগতের সাথে তাদের যোগাযোগ প্রায় থাকেই না। তাদের একমাত্র সঙ্গী হয়তো হয় টেলিভিশন বা স্মার্টফোন।

  • কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই: যদিও চুক্তিতে কাজের সময়সীমা লেখা থাকে, বাস্তবে তাদের প্রায় ২৪ ঘণ্টাই ডিউটির উপর থাকতে হয়। মধ্যরাতে বাচ্চার কান্না থামানো থেকে শুরু করে গভীর রাতে অতিথিদের জন্য কফি বানানো—সবই তাদের করতে হয়।

  • শোষণ এবং নির্যাতন: যদিও বেশিরভাগ নিয়োগকর্তাই ভালো আচরণ করেন, কিন্তু অনেকেই শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক শোষণের শিকার হন। পাসপোর্ট আটকে রাখা, সময়মতো বেতন না দেওয়া, বা সামান্য ভুলের জন্য কঠোর ভাষায় বকাঝকা করা—এই ঘটনাগুলো বিরল নয়।

তৃতীয় অধ্যায়: শুক্রবার—এক টুকরো স্বাধীনতার দিন সপ্তাহে একটি মাত্র দিন, সাধারণত শুক্রবার, তারা তাদের ছুটির দিনটি পান। এই একটি দিনই তাদের জন্য এক টুকরো স্বাধীনতার মতো। এই দিনে, তারা দুবাই বা কুয়েত সিটির নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় (যেমন: চার্চ বা পার্ক) একত্রিত হন।

  • কমিউনিটির বন্ধন: এই ছুটির দিনে তারা একে অপরের সাথে তাদের সুখ-দুঃখের গল্প করেন, একসাথে রান্না করে খান, এবং নিজেদের ভাষায় কথা বলে এক ধরনের মানসিক শান্তি খুঁজে পান। এই কমিউনিটিই হলো বিদেশের মাটিতে তাদের টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শক্তি।

  • দেশের সাথে সংযোগ: তারা ফিলিপিনো দোকানগুলো থেকে দেশের জিনিসপত্র কেনেন, এবং মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে তাদের কষ্টার্জিত বেতনের একটি বড় অংশ দেশে পাঠিয়ে দেন।

চতুর্থ অধ্যায়: স্বপ্নের মূল্য তাদের এই ত্যাগের পেছনে থাকে কিছু সুনির্দিষ্ট স্বপ্ন।

  • সন্তানদের শিক্ষা: তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটি ব্যয় হয় তাদের সন্তানদের ভালো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর জন্য।

  • একটি পাকা বাড়ি: গ্রামে একটি সুন্দর, পাকা বাড়ি তৈরি করাটা তাদের অনেকেরই জীবনব্যাপী স্বপ্ন।

  • ছোট ব্যবসা: দেশে ফিরে গিয়ে একটি ছোট দোকান বা ব্যবসা শুরু করার স্বপ্নও দেখেন অনেকে।

এই স্বপ্নগুলোই তাদের প্রতিদিনের কষ্ট এবং একাকীত্বকে সহ্য করার শক্তি জোগায়। তারা যখন ভিডিও কলে তাদের সন্তানের হাসিমুখ দেখে, তখন তাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

উপসংহার: মারিয়া এবং তার মতো লক্ষ লক্ষ ফিলিপিনো গৃহকর্মীরা কেবলই 'কর্মী' নন। তারা হলেন মা, স্ত্রী, এবং কন্যা, যারা তাদের প্রিয়জনদের একটি ভালো জীবন দেওয়ার জন্য নিজেদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছেন। তারা সেই অদৃশ্য নায়িকারা, যাদের শ্রম এবং ত্যাগের উপর ভিত্তি করে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক পরিবারের সচ্ছল এবং আরামদায়ক জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে। তাদের এই নীরব অবদান এবং আত্মত্যাগের গল্পটি সম্মান এবং স্বীকৃতির দাবিদার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!