গরুর ফুটবল ম্যাচ

0

চরগাঁও গ্রামে মানুষ যতই ঝগড়া-ঝাটি করুক, একটা ব্যাপারে সবাই একমত— খেলা ছাড়া জীবন নেই। খেলার জন্য ছেলেরা মাঠে, বুড়োরা আড্ডায়, মেয়েরা জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই খেলাটা যদি হয় গরুর ফুটবল ম্যাচ, তখন গোটা গ্রামই পাগল হয়ে যায়।

ঘটনাটা হলো— গত বছর ইদুল আজহার সময় গ্রামের ধনী মানুষ হাজি করিম সাহেব দুইটা দামি গরু কিনে আনলেন। নাম দিলেন— কালো মিয়া আর লালু। গরু দুটো এত সুন্দর, এত শক্তিশালী, দেখে মনে হলো মাঠে নামলে রোনালদো-মেসিকেও হার মানাবে।

মোড়ের চায়ের দোকানে বসেই আলাপ শুরু হলো,
“এই গরু দুইটা দিয়ে যদি খেলানো যেত, কী মজা হতো না?”

আলাপ থেকে প্রস্তাব, প্রস্তাব থেকে সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্ত থেকে বাস্তবায়ন— এক সপ্তাহের মধ্যেই আয়োজন হয়ে গেল গ্রামের প্রথম গরুর ফুটবল ম্যাচ

মাঠ হিসেবে বেছে নেওয়া হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার জায়গা। গোলপোস্ট বানানো হলো বাঁশ কেটে, জাল বানানো হলো পুরনো মশারি সেলাই করে। বল হিসেবে ব্যবহার হলো বিশাল এক লাল রঙের প্লাস্টিকের ড্রাম, যেটা গরুর ধাক্কায় গড়াগড়ি খাবে।

টিম ভাগ করা হলো—
একদিকে হাজি করিমের গরু কালো মিয়া, আরেকদিকে কুদ্দুস মিয়ার গরু পটলু। পটলু আসলে তেমন শক্তিশালী না, তবে তার এক বিশেষত্ব আছে— সে লাথি মারতে খুব ওস্তাদ।

মাঠে দর্শকের ভিড় দেখে মনে হলো, গ্রামে যেন বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে। দোকানিরা চা-বিস্কুট বিক্রি করছে, মহিলারা ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে আছে, বাচ্চারা গাছে চড়ে আছে। মুরুব্বিরা চেয়ার এনে বসেছে, যেন তারা ফিফার প্রেসিডেন্ট।

খেলা শুরুর আগে গরুদের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ঘণ্টা। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ছিল একটাই— গফুর মিয়ার হারমোনিয়াম, যেটা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খেলাও শুরু।

রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পেলেন মজিদ মাস্টার। কিন্তু সমস্যা হলো, গরুরা বাঁশির আওয়াজ শুনে থামে না, তারা চলে নিজের ইচ্ছায়। ফলে মাস্টার সাহেব যতই বাঁশি বাজান, গরুগুলো পাত্তাই দিল না।

খেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে কালো মিয়া বল (অর্থাৎ প্লাস্টিকের ড্রাম) ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিল। দর্শক চিৎকার করে উঠল,
“গোল! গোল!”

কিন্তু গোল হওয়ার আগেই পটলু এক লাফে এসে এমন ধাক্কা দিল যে ড্রামটা উড়ে গিয়ে দর্শকসারিতে গিয়ে পড়ল। এক বৃদ্ধার কোলের চায়ের কাপে গিয়ে পড়তেই চা ছলকে গরম হয়ে ঝলসে গেল তার হাত। বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“এই যে রেফারি, এ আবার কেমন খেলা রে বাবা?”

দর্শকরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি।

এরপর থেকে খেলাটা আর ফুটবল থাকল না, একেবারে কুস্তির আকার নিল। গরুরা বলের চেয়ে একে অপরকে ধাক্কা দিতে বেশি মজা পাচ্ছে। কালো মিয়া লাফ দিয়ে পটলুর পিঠে চড়ে বসল, পটলু আবার পিছন থেকে শিং দিয়ে খোঁচা মারল।

এমন সময় মাঠে দৌড়ে ঢুকে পড়ল হাজি করিমের ছোট ছেলে। সে চিৎকার করে বলল,
“বাবা বাবা, গরু মারামারি করছে! গরু যদি চোট খায়, কোরবানির সময় কী হবে?”

এবার হাজি করিম মাঠে ছুটে গিয়ে নিজের গরুকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গরু কি আর শোনে? কালো মিয়া উল্টো হাজি করিমকেই শিং দিয়ে ধাক্কা দিল। হাজি করিম উল্টে গিয়ে কাদায় পড়লেন। দর্শকের হাসি থামতেই চাইছে না।

খেলা যত এগোতে লাগল, তত মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। একবার তো ড্রাম বল মাঠ ছেড়ে পাশের খালের পানিতে গিয়ে পড়ল। তখন দুটো গরুই খালের ভেতর নেমে গেল, শুরু হলো নতুন খেলা— গরুর ওয়াটার পোলো

খাল থেকে যখন গরু উঠল, তখন তাদের গায়ে কাদা আর শাপলা ফুল। দর্শকরা তালি দিয়ে উঠল,
“বাহ, বাহ, এ তো একেবারে নতুন খেলা!”

শেষমেশ রেফারি ঘোষণা দিলেন, “খেলা ড্র।”

কিন্তু দর্শকেরা মানতে নারাজ। তারা বলে উঠল,
“না না, কালো মিয়া বেশি গোল দিয়েছে।”
আবার কেউ বলল,
“না, পটলুই জিতছে। ও লাথি বেশি মারছে।”

অবস্থা এমন হলো, খেলোয়াড় গরুর চেয়ে দর্শকরাই বেশি মারামারি শুরু করল। কেউ চিৎকার করছে, কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ আবার ড্রাম বল টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের উঠানে।

শেষে গ্রাম্য মুরুব্বিরা এসে সমাধান করলেন। সিদ্ধান্ত হলো— গরুর ফুটবল ম্যাচে কোনো জয়-পরাজয় নেই। খেলাটা শুধু বিনোদনের জন্য। আর গরু দুটোকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে— মাথায় মালা পরানো হবে, আর খেতে দেওয়া হবে এক বালতি গুর।

সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রতিটা মানুষ হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল। আর পরদিন মোড়ে চায়ের দোকানে সবাই গর্ব করে বলল,
“আমাদের গ্রামে খেলা হয় শুধু ফুটবল না, গরুর ফুটবল!”

এভাবেই চরগাঁও গ্রাম আবারও ইতিহাস গড়ল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!