বেলতলী গ্রামে মানুষের সবচেয়ে বড় শখ— লটারি খেলা। কারও ভাগ্যে যদি মোটরসাইকেল বা ফ্রিজ উঠে আসে, তাহলে গ্রামের সবাই তাকে ঈর্ষা করে মাসের পর মাস। কিন্তু এবারের লটারির আয়োজন ছিল একেবারে আলাদা।
কারণ এবার লটারির পুরস্কার ছিল— একটা দেশি মুরগি।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। গ্রামের সর্দার মজনু মোল্লা ঘোষণা দিলেন,
“গরু-ছাগল দেওয়া খুব ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। তাই এবারের পুরস্কার হবে আমার খামারের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মুরগি ‘টুনটুনী’। যে জিতবে, সে মুরগি পাবে।”
শুরু হলো গ্রামের উচ্ছ্বাস। সবাই বলল,
“মুরগিই তো আসল জিনিস! ডিম দেবে, মাংস দেবে, আবার ঘরে রক্ষা করবে। ফ্রিজে রাখলে বিদ্যুৎ খায়, কিন্তু মুরগি রাখলে শুধু ধান খায়!”
লটারির টিকিট বিক্রি শুরু হলো মোড়ের দোকানে। একেকজন ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনছে। কে না চায় টুনটুনীকে? এই মুরগি নাকি ডাক শুনে মানুষ চিনতে পারে, আবার মশা তাড়ায় ডানা ঝাপটে।
লটারির দিন এল। মাঠে হাজার লোক জড়ো হলো। মঞ্চ সাজানো হলো গামছা দিয়ে। মঞ্চের মাঝখানে রাখা হলো টুনটুনী মুরগি, যার গলায় বাঁধা রঙিন ফিতা।
ঘোষক গলা চড়িয়ে বলল,
“ভাইসব, আজকের বিশেষ আকর্ষণ— মুরগির লটারি! যে নম্বর উঠবে, সে-ই হবে সৌভাগ্যবান মালিক।”
মাঠে হট্টগোল শুরু হলো। কেউ বলল,
“আল্লাহ যেন আমার নামটা তুলে দেন।”
আবার কেউ বলল,
“এই মুরগি নিয়ে আমি আমার বউকে চমক দেব।”
ঘোষক টুপি থেকে কাগজ টেনে বের করলেন। নম্বর বের হতেই সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াল। ঘোষণা হলো— ৫৬ নম্বর টিকিট জিতেছে!
ভিড় থেকে লাফিয়ে উঠল হাশেম কাকা। তিনি চিৎকার করে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ, আমি জিতছি! আমি হাশেম কাকা, ৫৬ নম্বর টিকিট আমার।”
দর্শকেরা হাততালি দিল। টুনটুনী মুরগি হাশেম কাকার হাতে তুলে দেওয়া হলো।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হলো না।
মুরগি হাতে নিয়েই হাশেম কাকা গর্ব করে বাড়ির পথে রওনা দিলেন। পথের মাঝে মুরগি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গিয়ে বসলো অন্য এক দোকানের ছাদে। কাকা মরিয়া হয়ে দৌড়াচ্ছেন, মুরগি উড়ে বেড়াচ্ছে, পুরো গ্রাম হাসতে হাসতে পাগল।
এক পর্যায়ে মুরগি সরাসরি গিয়ে বসলো কুদ্দুস মিয়ার উঠানে। কুদ্দুস মিয়া সাথে সাথে দাবি করলেন,
“এই মুরগি আমার। আমার উঠানে এসেছে, মানে এটা আমার ভাগ্য।”
হাশেম কাকা তর্ক শুরু করলেন,
“তুমি পাগল নাকি? লটারিতে আমি জিতছি!”
দুজনের তর্ক এত দূর গেল যে শেষে গ্রাম্য সালিশ ডাকতে হলো। সালিশে মুরুব্বিরা বললেন,
“মুরগি কার হবে, সেটা নির্ধারণ করবে মুরগি নিজেই।”
মুরগি টুনটুনীর সামনে দুইটা পাত্র রাখা হলো— একটাতে ভাত, আরেকটাতে ভাজা মাছ। নিয়ম হলো, যদি টুনটুনী ভাত খায় তাহলে হাশেম কাকার হবে, আর যদি ভাজা মাছ খায় তাহলে কুদ্দুস মিয়ার হবে।
সবার চোখ টুনটুনীর দিকে। মুরগি একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ তৃতীয় দিকে গিয়ে মুরুব্বির পানির জগ উল্টে দিল।
দর্শকেরা চিৎকার করে উঠল,
“টুনটুনী সালিশ মানে না, নিজের ইচ্ছায় চলে!”
শেষ পর্যন্ত সমাধান হলো— টুনটুনী থাকবে গ্রামের স্কুলে, সবাই মিলে যত্ন করবে। আর স্কুলে যে প্রথম হবে প্রতি বছর, তাকে দেওয়া হবে টুনটুনীর একটি করে ডিম পুরস্কার হিসেবে।
এভাবেই টুনটুনী মুরগি গ্রামে কিংবদন্তি হয়ে গেল।