বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব: একটি জাতির অদৃশ্য রক্ত সঞ্চালন

0


ভূমিকা: একটি দেশের শরীর
যদি একটি দেশের অর্থনীতিকে একটি মানবদেহের সাথে তুলনা করা হয়, তবে এর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো স্পষ্ট। কৃষি হলো সেই দেহের কঙ্কাল, যা কাঠামোগত ভিত্তি প্রদান করে। শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, হলো তার পেশী, যা শক্তি এবং গতি সঞ্চার করে। কিন্তু এই কঙ্কাল এবং পেশীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তাদের কাছে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন এবং পুষ্টি পৌঁছে দেওয়ার জন্য, একটি শক্তিশালী এবং নিরবচ্ছিন্ন রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য, সেই জীবনদায়িনী রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থাটিই হলো রেমিট্যান্স। আর এই রক্তকে পাম্প করার কাজটি নিরলসভাবে করে চলেছে সেই অদৃশ্য 'হৃদপিণ্ড'—বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স হলো সেই রক্ত, যা দেশের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে, শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত, প্রতিটি কোষকে বাঁচিয়ে রাখে এবং পুষ্টি জোগায়।

প্রথম অধ্যায়: রক্ত সঞ্চালনের শারীরবৃত্ত (The Physiology of Remittance Flow)

  • হৃদপিণ্ড—প্রবাসী কর্মীরা: মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমি থেকে শুরু করে ইউরোপের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কারখানা—বিশ্বের প্রায় ১৮০টি দেশে কর্মরত এই মানুষগুলোই হলেন অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। তারা তাদের ঘাম এবং শ্রমকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত করে, এবং সেই মুদ্রা বা 'রক্ত' দেশের দিকে পাম্প করেন।

  • প্রধান ধমনী—বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল: যখন একজন প্রবাসী বৈধ পথে, অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেল বা এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে টাকা পাঠান, তখন সেই বৈদেশিক মুদ্রা সরাসরি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে জমা হয়। এটি হলো অর্থনীতির প্রধান ধমনী।

দ্বিতীয় অধ্যায়: রক্তের প্রধান কাজ—যেভাবে রেমিট্যান্স দেশকে বাঁচিয়ে রাখে

  • ১. অক্সিজেন সরবরাহ—বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ:

    • একটি দেশের অর্থনীতির সুস্থতার অন্যতম প্রধান সূচক হলো তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এই রিজার্ভই হলো সেই 'অক্সিজেন', যা দিয়ে দেশ তার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (যেমন: জ্বালানি তেল, খাদ্যশস্য, শিল্পের কাঁচামাল) আমদানি করার সামর্থ্য রাখে।

    • যখনই দেশের আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যায় (অর্থাৎ, ট্রেড ডেফিসিট দেখা দেয়), তখন এই রেমিট্যান্সই এসে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করে এবং 'ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট'-এ স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। এটি দেশের মুদ্রার মানকে স্থিতিশীল রাখতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • ২. পুষ্টি সরবরাহ—গ্রামীণ অর্থনীতি এবং দারিদ্র্য বিমোচন:

    • রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ সরাসরি গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায়। এটি হলো সেই 'পুষ্টি', যা তৃণমূল পর্যায়ের কোষগুলোকে সজীব করে তোলে।

    • ক্ষুদ্র বিনিয়োগ: এই টাকা দিয়ে একটি ছোট মুদি দোকান খোলা হয়, একটি অটোরিকশা কেনা হয়, বা জমিতে সেচের জন্য একটি পাম্প বসানো হয়। এই ছোট ছোট বিনিয়োগগুলোই গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করে।

    • জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো খাবার, পোশাক, এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়। সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার হার বাড়ে। কাঁচা বাড়ির জায়গায় একটি পাকা বাড়ি তৈরি হয়। রেমিট্যান্স সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে।

  • ৩. কোষ পুনর্গঠন—বিনিয়োগ এবং উদ্যোক্তা তৈরি:

    • অনেক প্রবাসীই তাদের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে এসে ছোট বা মাঝারি শিল্প (SME) প্রতিষ্ঠা করছেন। তারা তাদের বিদেশের অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশের শিল্প খাতে নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসছেন।

তৃতীয় অধ্যায়: সংবহন তন্ত্রের রোগ—যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে

এই জীবনদায়িনী রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থাটিও কিছু মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে।

  • ১. রক্তক্ষরণ—হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেল:

    • যখন টাকা অবৈধ পথে বা 'হুন্ডি'-র মাধ্যমে পাঠানো হয়, তখন সেই বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে প্রবেশ করে না। এটি অনেকটা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের মতো, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু শরীরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়। হুন্ডি অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং-এর মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে এবং দেশের অর্থনীতিকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে।

  • ২. উচ্চ রক্তচাপ—অভিবাসনের উচ্চ ব্যয়:

    • অনেক কর্মীকে বিদেশে যাওয়ার জন্য চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় বা জমিজমা বিক্রি করতে হয়। এই ঋণের বোঝা তাদের উপর এক প্রচণ্ড মানসিক এবং আর্থিক চাপ তৈরি করে, যা অনেকটা উচ্চ রক্তচাপের মতো।

  • ৩. পেশী অবশ—দক্ষতার অভাব এবং শ্রমিক শোষণ:

    • আমাদের বেশিরভাগ প্রবাসীই অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যান, যার ফলে তারা কম বেতন পান এবং প্রায়শই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হন। যদি আমরা আমাদের কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা দিয়ে পাঠাতে পারি, তাহলে তাদের আয় এবং দেশের রেমিট্যান্স দুটোই বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

চতুর্থ অধ্যায়: চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ—সরকারের ভূমিকা এই রোগগুলো প্রতিরোধের জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ 'চিকিৎসা' প্রদান করতে হবে।

  • 'ভিটামিন' সরবরাহ—নগদ প্রণোদনা: সরকার কর্তৃক বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে ২.৫% নগদ প্রণোদনা প্রদান করার সিদ্ধান্তটি হুন্ডিকে নিরুৎসাহিত করার জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর 'টনিক' হিসেবে কাজ করছে।

  • 'বাইপাস সার্জারি'—দক্ষতা উন্নয়ন: বিদেশে পাঠানোর আগে, কর্মীদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন কারিগরি এবং ভাষা শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করতে হবে, যাতে তারা উচ্চ বেতনের চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে।

  • 'টিকা'—শ্রমিকদের সুরক্ষা: বিদেশে কর্মরত কর্মীদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য দূতাবাসগুলোর ভূমিকা আরও সক্রিয় এবং শক্তিশালী করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নামক এই শরীরটি তার হৃদপিণ্ড, অর্থাৎ তার প্রবাসী কর্মীদের, কাছে ঋণী। তাদের পাঠানো রক্তের প্রতিটি ফোঁটাই এই দেশের অগ্রযাত্রার একেকটি গল্প লিখে চলেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Out
Ok, Go it!